বৈষম্য নারীর মস্তিষ্কে অদৃশ্য ক্ষত তৈরি করে
বিবিসির প্রতিবেদনে গবেষণা প্রতিবেদনটির বিস্তারিত তুলে ধরে বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অবাঞ্ছিত যৌন মনোযোগ প্রায়ই তাৎক্ষণিক হুমকি হয়ে ওঠে না। এটিকে উপেক্ষা করা হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, এর স্থায়ী মানসিক প্রভাব নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনন্দিন জীবনে এ ধরনের ক্রিয়াকলাপের প্রতিক্রিয়া মানুষের শরীর ও জীবনে ছড়িয়ে পড়ে।
গত বুধবার ব্রিটিশ গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত শতাব্দীতে নারী অধিকার আন্দোলন ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। অনেক দেশেই সমান বেতন এখন আইনি বাধ্যবাধকতা; পাশাপাশি অবৈধ হয়েছে লিঙ্গবৈষম্য। যুক্তরাজ্য তিন নারী প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে নারী নেত্রীদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। তথাপি উদ্বেগ রয়ে গেছে। কারণ, যুক্তরাজ্যসহ সারাবিশ্বে লিঙ্গসমতা এখন স্থবির অবস্থায়, এমনকি কোথাও এটি পেছনের দিকেও যাচ্ছে। লিঙ্গসমতা কেবল বেতন বৈষম্যের পরিসংখ্যানে দাঁড়িয়ে আছে। নারী ও মেয়ে শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়ছে।
বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যানগুলো যে তথ্য দিচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। প্রায় তিন নারীর একজন শারীরিক বা যৌন সহিংসতা বা উভয় ধরনের সহিংসতার শিকার। পাশাপাশি যৌনতাবাদের সূক্ষ্ম রূপ রয়েছে, যা দৈনন্দিন জীবনে ছড়ানো। নারীরা স্নেহময়ী ও আবেগি, অপরদিকে পুরুষ যুক্তিবাদী ও প্রভাবশালী– এমন ধারণা থেকে আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক লিঙ্গভিত্তিক প্রশংসার উদার যৌনতাবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। এসব ধারণা লিঙ্গবৈষম্যের মধ্যেই নিহিত, যা নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষতি করতে পারে। সেই সঙ্গে তাদের ‘অধীনস্থ অবস্থা’কে শক্তপোক্ত করতে পারে।
ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী প্যাট্রিসিয়া হোমান ও তাঁর সহকর্মীদের তৈরি দ্য লেনসেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি একটি সরকারি ওয়েবসাইট থেকে নারীর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য মুছে ফেলা হয়। আর যে তথ্য যোগ করা হয়েছে, তা জৈবিক যৌন প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরদার করে, নারীর শরীরকে দুর্বল ও সুরক্ষার প্রয়োজন বলে চিত্রিত করে। সেখানে ট্রান্সজেন্ডারদের হুমকি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
মস্তিষ্কে একটি ‘ক্ষত’
বৈষম্যমূলক আচরণ ও সূক্ষ্ম যৌনতা নারীর স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। তবে এটা সর্বদা তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান হয় না। ২৯টি দেশে সাত হাজার ৮০০টিরও বেশি মস্তিষ্কের স্ক্যান বিশ্লেষণ করে একটি বৃহৎ গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতা নারীর মস্তিষ্ককে শারীরিকভাবে পরিবর্তন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ লিঙ্গ বৈষম্যযুক্ত দেশগুলোতে বসবাসকারী নারীর মস্তিষ্কের অঞ্চলে পাতলা কর্টিকাল পুরুত্ব থাকে, যা মানসিক নিয়ন্ত্রণ, স্থিতিস্থাপকতা, হতাশা ও আঘাত-পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের মতো চাপ-সম্পর্কিত ব্যাধির সঙ্গে যুক্ত।
চিলির পন্টিফিকাল ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিকোলাস ক্রসলি বলেন, নারীরা যে বৈষম্যের সম্মুখীন হন, তা ‘তাদের মস্তিষ্কে একটি দাগ রেখে যায়’। বৈষম্যের চাপে মস্তিষ্ক পরিবর্তিত হতে পারে। এর কারণ প্লাস্টিসিটি নামক প্রক্রিয়া। আমরা যা অনুভব করি বা শিখি, তার ওপর নির্ভর করে মস্তিষ্ক কীভাবে অভিযোজিত হয়।
ক্রসলির ব্যাখ্যা, যদি জাগলিংয়ের মতো দক্ষতা মস্তিষ্কে দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখায়, তাহলে আপনাকে অবমূল্যায়ন করে– এমন একটি সমাজে চলাচলের একটি গভীর অভিজ্ঞতার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। কারণ, দীর্ঘ সময়ের চাপ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক অভিযোজন ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে। নিকোলাস ক্রসলি বলেন, যদি আপনি লিঙ্গবৈষম্য কমাতে সক্ষম হন, তাহলে নারীর স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হবে।
প্রতি ৫ জনের একজন বৈষম্যের শিকার
অন্যান্য গবেষণায়ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর লিঙ্গবৈষম্যের প্রভাব দেখা গেছে। যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব নারী লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য চার বছর পর আরও খারাপ হয়েছে। প্রায় তিন হাজার নারীর ওপর করা গবেষণায় প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন যৌন বৈষম্যের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে– জনসাধারণের জন্য অনিরাপদ বোধ করা থেকে শুরু করে অপমানিত হওয়া বা শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হওয়া। এসব নারীর ক্ষেত্রে মানসিক যন্ত্রণা ও জীবনবিমুখ হওয়ার শঙ্কা স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেশি।
গবেষণার প্রধান লেখক কিংস কলেজ লন্ডনের স্বাস্থ্য মনোবিজ্ঞানী রুথ হ্যাকেট বলেন, বারবার চাপের অভিজ্ঞতার সংস্পর্শে আসায় শরীরিক ক্ষতি হতে পারে। পরে সেই ক্ষতিকারক জৈবিক পরিবর্তন দুর্বল মানসিক সুস্থতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
আরও পড়ুন স্বাস্থ্য খরচের চাপে আর্থিক বিপর্যয়ে ৪৪% পরিবার
ঢাকাভয়েস/এই


No comments