গাজার রক্তভেজা ইতিহাস: অটোমান অঞ্চল থেকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার’
অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আধুনিক বিভাজন
গাজা উপত্যকার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন মিশরীয় যুগ থেকে শুরু করে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, রোমান সাম্রাজ্য, মুসলিম জেনারেল আমর ইবনে আল-আস, সবাই কোনো না কোনো সময় এই অঞ্চল দখল করেছে।১৬ শতক থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ থাকা গাজা ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে।১৯১৯ সালের প্যারিস শান্তি সম্মেলনের পর, ইউরোপীয় শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ভাগ করে নেয়। গাজা তখন ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ফিলিস্তিনের অংশ হিসেবে পরিচালিত হতে থাকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত।
১৯৪৮: জন্ম নেয় ইসরায়েল, শুরু হয় গাজার দুর্দশা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটেন ফিলিস্তিন প্রশ্ন জাতিসংঘের হাতে তুলে দেয়। ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর প্রস্তাবে ফিলিস্তিনকে ইহুদি ও আরব দুই রাষ্ট্রে ভাগ করা হয়।ইসরায়েল ১৯৪৮ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার পরই শুরু হয় প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, এবং হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজায় আশ্রয় নেয়। যুদ্ধের পর গাজা মিশরের নিয়ন্ত্রণে যায়, যা টিকে ছিল ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত।
১৯৬৭ থেকে ইসরায়েলি দখল ও প্রতিরোধের সূচনা
ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে জয়লাভের পর গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নেয়।১৯৮৭ সালে গাজা থেকেই শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের প্রথম ইন্তিফাদা বা গণঅভ্যুত্থান। একই বছর প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামপন্থী সংগঠন হামাস, যা ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে গাজা ও পশ্চিম তীরে সীমিত স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা পায়। তবে স্থায়ী শান্তি কখনও ফেরেনি।
হামাসের উত্থান ও ইসরায়েলি অবরোধ
২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাসের বিজয়ের পর ২০০৭ সালে গাজায় শুরু হয় হামাস ও ফাতাহর মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ। ফাতাহর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়।এরপর থেকেই ইসরায়েল ও মিশর গাজায় কড়া স্থল, আকাশ ও সমুদ্র অবরোধ আরোপ করে, যা এখনো চলমান।ইসরায়েল দাবি করে, এটি নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয়; কিন্তু জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এটি এক ধরনের সমষ্টিগত শাস্তি, যা গাজাকে “একটি উন্মুক্ত কারাগার”-এ পরিণত করেছে।
অবরোধ, সুড়ঙ্গ ও টিকে থাকার লড়াই
গাজার অর্থনীতি কার্যত ধ্বংসপ্রাপ্ত। ইসরায়েল প্রায় সব রপ্তানি-আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে, এবং মানুষের চলাচল কঠোরভাবে সীমিত।হামাস এর জবাবে গাজা জুড়ে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, যেগুলোর মাধ্যমে খাদ্য, ওষুধ, পণ্য ও অস্ত্র পাচার করা হয়। ইসরায়েল এই সুড়ঙ্গগুলোকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং প্রায়ই সেগুলোতে বিমান হামলা চালায়।
অর্থনীতি, মানবাধিকার ও দৈনন্দিন বেঁচে থাকা
১৬ বছরের অবরোধে গাজার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে।
•বেকারত্বের হার: প্রায় ৪০% (বিশ্বব্যাংক)
•দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী: ৬৫% (জাতিসংঘ)
•খাদ্য অনিরাপদ জনগোষ্ঠী: ৬৩% (বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি)
জাতিসংঘের হিসাবে, গাজার অর্ধেক মানুষ ১৯ বছরের নিচে বয়সের তরুণ—যাদের বেড়ে ওঠা যুদ্ধ ও হতাশার ছায়ায়।বিদ্যুৎ থাকে দিনে মাত্র ৩ ঘণ্টা, বিশুদ্ধ পানির অভাব ভয়াবহ, আর হাসপাতালগুলো প্রায়ই ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত।
বিশ্বের বিবেকের প্রশ্ন
আন্তর্জাতিক রেডক্রস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সবাই গাজার অবরোধকে বেআইনি ও অমানবিক বলে অভিহিত করেছে।ইসরায়েল বলছে এটি নিরাপত্তার জন্য আবশ্যক, কিন্তু গাজা আজও বিশ্বের চোখে অবরুদ্ধ, নিপীড়িত ও বিপর্যস্ত এক মানবিক ট্র্যাজেডি।
আরও পড়ুন ট্রাম্পের চোখে নেতানিয়াহু ‘বোঝা’ হয়ে উঠছেন — ইসরায়েলি বিশ্লেষকের মন্তব্য
ঢাকা ভয়েস/এই
No comments