ডাক্তাররা কি ওষুধ কোম্পানির উপহার গ্রহণ করতে পারবেন ? যা বলছে ইসলাম
চিকিৎসা পেশা মানবসেবার এক মহান দায়িত্ব। একজন চিকিৎসক তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও নৈতিকতার আলোকে রোগীর সুস্থতা ও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাই বলা যায় শরীয়ত চিকিৎসকদের ওপর আরোপ করেছে একটি গুরত্বপূর্ণ নৈতিক দায়িত্ব। আর তা হলো- রোগীর কল্যাণ ও মঙ্গলকেই সর্বাগ্রে রাখা।
বর্তমান যুগে ওষুধ প্রস্তুতকারী অনেক কোম্পানি ডাক্তারদের বিভিন্ন সুবিধা, কমিশন বা উপহার (হাদিয়া) দিয়ে থাকে। এর ফলে প্রশ্ন আসে, চিকিৎসকের জন্য কোম্পানির দেওয়া এই উপহার বা সুবিধা গ্রহণ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কি না? বাংলাদেশের খবরের পাঠকদের জন্য নির্ভরযোগ্য ফতোয়ার কিতাব ও ফকীহগণের ব্যাখ্যার আলোকে বিষয়টি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
১. রোগীর স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখা চিকিৎসকের ধর্মীয় দায়িত্ব
রোগীর অবস্থা ও প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ ওষুধ নির্বাচন করা চিকিৎসকের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। যদি ডাক্তার তার দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ সততা বজায় রাখেন এবং কোম্পানির কোনো উপহার তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত না করে, তবে স্বেচ্ছাভিত্তিক উপহার গ্রহণকে শরীয়ত সরাসরি নিষিদ্ধ করেনি। ফতোয়া আল-বাজ্জাজিয়া মাআল-ফাতাওয়াল হিন্দিয়া-তে উল্লেখ আছে, ইমাম আল-বাজ্জাজ (রহ.) বলেন, ‘ঋণগ্রহীতার উপহার গ্রহণে অসুবিধা নেই, যদি তা শর্তসাপেক্ষ না হয়। যদি দাতা পূর্ব থেকেই উপহার দেওয়ার অভ্যস্ত হন বা উদার প্রকৃতির হন, তবে এমন উপহার গ্রহণে কোনো দোষ নেই।’ (মাকতাবা যাকারিয়া, খণ্ড ৬, পৃ. ৩৬২) এই নীতির ভিত্তিতে বলা যায়, যেসব উপহার স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয় বা শর্তযুক্ত নয়, সেগুলো গ্রহণ করা বৈধ।
২. বৈধ পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্ত উপহার
ফতোয়ায়ে রশিদিয়া-তে হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) লিখেছেন, ‘কোনো বৈধ কাজে চেষ্টা বা সহযোগিতা করলে তার বিনিময়ে কিছু গ্রহণ করা বৈধ, যতক্ষণ না কাজটি বাধ্যতামূলক দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে কাজ সম্পন্নের আগে উপহার গ্রহণ করলে বা নিজে দাবি করলে তা হারাম ও ঘুষ হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু বিনা দাবিতে কেউ স্বেচ্ছায় দিলে তাতে অসুবিধা নেই।’ (মাকতাবা যাকারিয়া, পৃ. ৫২৭) অতএব, যদি ডাক্তার রোগীর কল্যাণ বিবেচনায় ওষুধ নির্ধারণ করেন এবং কোনো স্বার্থের দাবিতে কোম্পানির সুবিধা গ্রহণ না করেন, তবে পরবর্তীতে দেওয়া উপহার ঘুষ হিসেবে গণ্য হয় না। রাদ্দুল মুহতার-এ ইবনু আবিদীন (রহ.) দুই ধরনের উপহার বর্ণনা করেছেন- ১. উভয়ের জন্য হালাল — সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার ভিত্তিতে। ২. উভয়ের জন্য হারাম — অন্যায়ে সহায়তার উদ্দেশ্যে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, যদি কোনো শর্ত ছাড়াই পরে উপহার দেওয়া হয়, তা হালাল। তবে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত বা প্রভাবশালী অবস্থানে আছেন (যেমন বিচারক, ইমাম, মুআজ্জিন, ডাক্তার ইত্যাদি), তাদের জন্য এ ধরনের উপহার সন্দেহযুক্ত, যদি না তা কেবল সৌজন্য বা কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হয়।
৩. দারুল উলুম করাচির ফতোয়া
দারুল উলুম করাচির সিনিয়র মুফতিয়ানদের এক ফতোয়ায় বলা হয়েছে, চিকিৎসা এমন একটি পেশা যেখানে রোগীর স্বার্থ রক্ষা করা সর্বপ্রথম ধর্মীয় দায়িত্ব। যদি ডাক্তার ব্যক্তিগত লাভের জন্য রোগীর ক্ষতি করেন বা অনুপযুক্ত ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন, তা গুনাহ ও বিশ্বাসভঙ্গ। কিন্তু যদি সততা, ন্যায় ও রোগীর মঙ্গল বিবেচনায় ওষুধ নির্ধারণ করা হয় এবং নিচের শর্তগুলো পূরণ করা হয়, তাহলে কোম্পানির দেওয়া হাদিয়া বা কমিশন কিছু ক্ষেত্রে অনুমোদনযোগ্য।
শর্তসমূহ :
১. কমিশনের লোভে নিম্নমানের বা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ নির্ধারণ করা যাবে না।
২. রোগীর জন্য বেশি উপযোগী অন্য কোম্পানির ওষুধ থাকলে সেটি বর্জন করা বৈধ নয়।
৩. কোম্পানি যেন উপহারের খরচ রোগীর ওষুধের দামে চাপিয়ে না দেয়।
৪. কমিশনের কারণে ওষুধের মান কমানো বা মানহীন পণ্য সরবরাহ করা যাবে না।
৫. ব্যবহৃত ওষুধ অবশ্যই উপকারী ও যুক্তিসঙ্গত মূল্যের হতে হবে।
এই শর্তগুলো অমান্য করলে কোম্পানির উপহার বা কমিশন গ্রহণ হারাম এবং কোম্পানির পক্ষ থেকেও এমন প্রলোভনমূলক উপহার প্রদান গুনাহ। (আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত) ফতোয়া নাম্বার ১৪৪০১২২০০৬৫২
সুতরাং, চিকিৎসক যদি রোগীর স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে আমানতদারির সাথে কাজ করেন, তবে কোম্পানির শর্তহীন ও প্রভাবমুক্ত উপহার গ্রহণ করা জায়েজ। কিন্তু উপহার যদি চিকিৎসা-নীতির পরিপন্থী হয়, রোগীর ক্ষতি করে বা পক্ষপাত তৈরি করে, তবে তা ঘুষ, হারাম ও গুনাহ। ইসলামী শরীয়তের আলোকে চিকিৎসা পেশায় নৈতিকতা ও আল্লাহভীতিই মূল।
অতএব, চিকিৎসক ও কোম্পানি উভয়ের উচিত সততা, আমানতদারি ও আল্লাহভীতির চেতনায় নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করা।
ঢাকা ভয়েস /এসএস
No comments