জনপ্রিয় ব্র্যান্ড কেয়া কসমেটিকস যেভাবে বাজার হারাল
সাফল্যের সোনালী অধ্যায়
১৯৯৬ সালে শিল্পপতি আবদুল খালেক পাঠানের হাত ধরে কেয়া কসমেটিকস লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। বিদেশি পণ্যের ভিড়ে একটি দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে কেয়া এগিয়ে আসে। অল্প সময়ে ‘কেয়া সুপার বিউটি সোপ’, ‘কেয়া লেমন সোপ’, ‘লাইফগার্ড সোপ’ এবং ‘কেয়া অ্যাকটিভ টুথপেস্ট’ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মের দাবদাহে ‘কেয়া প্রিকলি হিট পাউডার’ বা ‘আইস ম্যাজিক পাউডার’ মধ্যবিত্তের পরম স্বস্তির নাম হিসেবে পরিচিত হয়।
আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও সৃজনশীল ব্র্যান্ডিং
কেয়া কসমেটিকসের জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তাদের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন। তারা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে টেলিভিশন বিজ্ঞাপন তৈরি করত, যা আধুনিক, রুচিশীল এবং আকর্ষণীয় ছিল।‘রূপের রানী, গুণের রানী, কেয়া সুপার বিউটি সোপের রানী’– এই বিজ্ঞাপন তখন মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। বিজ্ঞাপন কেবল পণ্যের প্রচার করত না, বরং মধ্যবিত্তকে একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখাত। এই ধরনের সফল ব্র্যান্ডিং-এর কারণে কেয়া শুধুমাত্র একটি পণ্য নয়, সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবেও পরিচিত হয়েছিল।তবে সমস্যা হলো, কেয়া তখন থেকে নতুনত্বের দিকে অগ্রসর হয়নি। একই ধাঁচের বিজ্ঞাপন ও প্যাকেজিং নিয়েই তারা সীমাবদ্ধ ছিল। মার্কেটিং ভাষায় এটিকে ‘স্পেকটিক্স মডেল’ বলা হয়।
একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের বাজার হারানোর কারণ
কেয়ার পতনের পেছনে একক কারণ ছিল না; এটি একাধিক ভুলের সমষ্টি। প্রধান কারণগুলো হলো—
১. সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থতা : কেয়া তাদের পুরোনো জনপ্রিয় পণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। নতুন প্রজন্মের ভোক্তাদের জন্য উদ্ভাবনী পণ্য আনতে ব্যর্থ হয়। বিশ্বজুড়ে লিকুইড সোপ, ফেসওয়াশ, ময়েশ্চারাইজার, সানস্ক্রিন বা শ্যাম্পুর চাহিদা বাড়লেও কেয়া সীমিত পণ্য তালিকাতেই আটকে ছিল।
২. বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন : ইউনিলিভার, প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, ম্যারিকোসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বাজারে আধুনিক বিপণন কৌশল ও বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে প্রবেশ করে। গবেষণা ও উন্নয়নে তাদের ক্ষমতার সামনে দেশীয় কোম্পানিগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
৩. বিপণন কৌশলে স্থবিরতা : যে বিজ্ঞাপন কেয়াকে শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল, সেই একই ধারায় তারা বহু বছর আটকে থাকে। ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার না করায় নতুন প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়নি। ফলে ব্র্যান্ড ইমেজ ‘পুরোনো দিনের ব্র্যান্ড’ হিসেবেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
৪. অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক সংকট : অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা, ব্যাংক ঋণ এবং আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্বল করে। ব্যাংক ঋণখেলাপির খবর প্রকাশিত হলে ভোক্তাদের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে পণ্যের গবেষণা, উন্নয়ন বা বিজ্ঞাপনে বিনিয়োগের সক্ষমতা হারানো হয়।
দীর্ঘ এক যুগের আভিজাত্যের অবসান
দীর্ঘদিন লোকসান ভোগ করা কেয়া কসমেটিকস অবশেষে তাদের কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি কোম্পানির বন্ধ নয়, বরং কয়েক হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ফেলে। এটি আমাদের শেখায়, সময়ের সঙ্গে ক্রেতার চাহিদা, পছন্দ-অপছন্দ এবং আচরণ পরিবর্তিত হয়। কোনো ব্র্যান্ড যদি তা হালকাভাবে নেয়, দীর্ঘস্থায়ী ব্যবসা করা অসম্ভব |
আরও পড়ুন দ্রুত ওজন কমাতে কত গতিতে হাঁটা উচিত
ঢাকাভয়েস/এই
No comments