Adsterra

লোড হচ্ছে...

আওয়ামী শাসনামলে শিক্ষা খাত ধ্বংসের হোতারা এখনো অধরা

 

আওয়ামী শাসনামলে শিক্ষা খাত ধ্বংসের হোতারা এখনো অধরা, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Trending News, Viral News, Top News, Hot News, bangla news,bangladesh

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর এ মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র হয়েছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে দেশের অন্যতম একটি ক্ষতিগ্রস্ত খাত ছিল শিক্ষা। বিতর্কিত শিক্ষানীতি ও কারিকুলাম প্রণয়ন, ক্ষতিকর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও নিয়ম-নীতি, ভুল ও বিকৃত তথ্যসংবলিত পাঠ্যবই প্রকাশ, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, নগ্ন দলীয়করণ, প্রশ্নফাঁস, সনদ জালিয়াতি, মানহীন শিক্ষক নিয়োগ, প্রকল্পের নামে লুটপাটসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ভয়াবহ দুর্নীতির বিস্তার ঘটে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতনের মধ্যদিয়ে শিক্ষা খাতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের গতি সাময়িকভাবে থেমেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনে বেশকিছু রদবদল, পদোন্নতিসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পূরণ এবং তাদের কল্যাণে কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এ সময়ে শিক্ষা খাত ধ্বংসে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার বড় কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ কারণে আওয়ামী দোসর ও সুবিধাভোগীরা নানাভাবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর দৃশ্যমান কোনো ফলাফল গত এক বছরে দেখা যায়নি। ধ্বংসপ্রায় শিক্ষা খাত সংস্কারেরও বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। অনেকটা জগাখিচুড়ির মতো পুরোনো কারিকুলামে চলছে মাধ্যমিক শিক্ষা। এতে সংশ্লিষ্টদের মাঝে চরম ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। শিক্ষা খাত তথা জাতিকে ধ্বংসের কাজে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল।

সূত্রমতে, নাস্তিক হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে প্রণীত বিতর্কিত জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ দিয়ে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে। পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় অনিয়ম ও দলীয় বিবেচনায় তুলনামূলক অযোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে দুর্নীতিকে অঘোষিতভাবে উৎসাহিত করা হয়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এবং আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক নেতাদের যৌথ মদতে চলে সব দুর্নীতি। তাদের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস-নৈরাজ্যে অস্থির হয়ে ওঠে গোটা শিক্ষা খাত। ব্যাহত হয় শিক্ষার স্বাভাবিক গতি। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের পেছনে পাশের দেশ ভারতের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রেরও অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে বেশি অসন্তোষ দেখা দেয়। বিভিন্ন কারণে এ সরকারের সময় প্রথম দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষা উপদেষ্টার পদ থেকে সাত মাসের মাথায় ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়টিতে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আমিনুল ইসলামও পদত্যাগ করেন। পরে শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার।

শিক্ষা খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ সম্পর্কে শিক্ষা উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, বিগত দিনের সব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মানহীন শিক্ষক নিয়োগ, অতিরিক্ত খরচ, প্রকল্পের নামে দুর্নীতি, পাঠ্যবই নিয়ে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিভিন্ন খাতে জড়িতদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। শিগগির একটি কমিটি গঠন করে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হবে। শ্বেতপত্র অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও মন্ত্রণালয়টি জানিয়েছে। এছাড়া জুলাই বিপ্লবে হতাহতদের বীরোচিত কর্মকাণ্ড নিয়েও একটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালায়ের।


আওয়ামী মার্কা নির্বাচন ঠেকাতে উদ্যোগ ইসিরআওয়ামী মার্কা নির্বাচন ঠেকাতে উদ্যোগ ইসির

তবে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়টির কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের বিদায়ী সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম জানান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির আওতায় সাতজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

জানতে চাইলে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের মহাসচিব জাকির হোসেন আমার দেশকে বলেন, আধুনিক গুণগত মানসম্মত শিক্ষা কারিকুলাম ছাড়া শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। পরিতাপের বিষয়, বিগত ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট সরকার পাশের দেশের প্রেসক্রিপশনে এবং তাদের খুশি রাখতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বড় আঘাত করেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও বর্তমান সরকার শিক্ষা খাতের উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সংস্কারের নামে বিভিন্ন কমিটি গঠন করলেও শিক্ষা সংস্কার কমিটি হয়নি। এমনকি ফ্যাসিস্টের দোসরদের দ্বারা সাজানো শিক্ষা প্রশাসন দিয়ে শিক্ষা বিভাগ চালানা হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জাকির হোসেন আরো বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসকারী কর্মকর্তারা সগর্ভে বহাল তবিয়তে রয়েছের। তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে কারিকুলাম পরিবর্তনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। অবিলম্বে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ দাবি করছি এবং শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।

শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর হত্যা-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে এরই মধ্যে শিক্ষা খাত ধ্বংসের অন্যতম হোতা ডা. দীপু মনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। সম্প্রতি কারারুদ্ধ হয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবাজ ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। সম্প্রতি বিক্ষোভের মুখে শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করা হয়। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য কারো বিরুদ্ধে বড় ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে দুর্নীতিবাজদের মাঝে কিছুটা স্বস্তি বিরাজ করছে।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার জন্য উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদরাসা শিক্ষা, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড ইত্যাদি। শিক্ষার স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি সব অনিয়ম-দুর্নীতিও এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে। তবে জুলাই বিপ্লবের পর জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও অপার সুযোগ এলেও ফ্যাসিবাদ ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এখনো যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। আন্তরিক হলে বাকি মেয়াদেই অনেক উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এ প্রসঙ্গে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু বলেন, আওয়ামী সরকারের প্রথম মেয়াদে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন রাশেদ খান মেনন। তিনি স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার পরিবর্তে লটারি পদ্ধতি চালু করেন। অর্থাৎ শিক্ষাকে লটারিতে রূপ দেন। বিগত সরকার ২০১০ সালে একটি শিক্ষানীতি করলেও ১৫ বছরেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। স্বাভাবিক শিক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে একবার সৃজনশীল পদ্ধতি, আরেকবার নতুন কারিকুলামের নামে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যাপক ক্ষতি করা হয়। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে চলে লুটপাট। কোচিংবাণিজ্য ও নোট-গাইড বই নিষিদ্ধের নীতিমালা হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি।

জিয়াউল কবির দুলু বলেন, শিক্ষা খাত ধ্বংসের পেছনে মন্ত্রী, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই দায়ী। পরিকল্পিতভাবে শিক্ষাব্যবস্থা তথা জাতিকে যারা ধ্বংসের কাজে জড়িত ছিল, তাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।


শিক্ষামন্ত্রী নাহিদের সময় যত ক্ষতি

আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় (১০ বছর) শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। তার সময় শিক্ষা খাতে বড় ক্ষতিও হয়েছে। সূত্রমতে, নাহিদের সময় এসএসসি, এইচএসসি থেকে শুরু করে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত প্রায় সব স্তরে প্রশ্নপত্র ফাঁস ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ফলে শিক্ষার্থীদের মেধা, পরিশ্রম ও যোগ্যতা অবমূল্যায়িত হয়। অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আস্থা হারান।

প্রশ্নফাঁসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তিনি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন। প্রশাসনিক দুর্বলতা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভেতরে দুর্নীতি বেড়ে যায়। শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতেও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু হওয়ায় শিক্ষার্থীরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এছাড়া রাজনৈতিক কারণে পাসের হার বেশি দেখাতে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর খাতা মূল্যায়নে ওভার মার্কিংয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে শিক্ষার মানে ধস নামে।

ওই সময় কোচিং বাণিজ্য, নোট-গাইড ব্যবসার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজে অস্বাভাবিক টিউশন ফি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি এবং প্রেস মালিকদের যোগসাজশে ভয়াবহ দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, যা আওয়ামী সরকারের পতন পর্যন্ত পরবর্তী মন্ত্রীদের সময় আরো বেড়ে যায়। এমনকি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে ২০২৫ সালের বই ছাপার কাজে ব্যাপক দুর্নীতির খবর পাওয়া যায়। আগামী বছরের বই নিয়েও দুর্নীতির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফ্যাসিবাদের দোসর প্রেস মালিকরা। শিক্ষা খাতের অনেক ক্ষতি সাধন করেও পার পেয়ে গেছেন সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে আছেন। তার বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার।


বিতর্কিত কারিকুলাম চালুর চেষ্টা দীপু মনি ও নওফেলের

আওয়ামী সরকারের তৃতীয় মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ডা. দীপু মনি। যথাযথ দক্ষতা না থাকলেও মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি তিনি ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেশে বিতর্কিত একটি কারিকুলাম চালুর চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীদের মেধা ও নৈতিককতা ধ্বংসকারী ওই কারিকুলামের বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের চরম বিরোধিতাকেও উপেক্ষা করেন তিনি। এমনকি কারিকুলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় অনেক শিক্ষককে গ্রেপ্তারসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। দীপু মনির পাশাপাশি শিক্ষা উপমন্ত্রী হিসেবে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের নেতৃত্বে শিক্ষা খাতকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বানানো হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের চতুর্থ মেয়াদের ছয় মাসে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে দুর্নীতির ওই ধারা আরো বাড়িয়ে দেন নওফেল। খুন-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধে দীপু মনি কারারুদ্ধ থাকলেও দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন নওফেল।


প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকিরের বাসায় ঘুসের টাকা নিয়ে সংঘর্ষ

আওয়ামী সরকারের সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি ছিল ওপেন সিক্রেট। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের সরকারি বাসভবনে ঘুসের টাকা ফেরত চাওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়। সূত্রমতে, সহকারী শিক্ষক নিয়োগের নাম করে কয়েকজন প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেন মন্ত্রীর লোকজন। কিন্তু চাকরি না পেয়ে ওই টাকা ফেরত চান তারা। একপর্যায়ে মিন্টো রোডে মন্ত্রীর বাসভবনে এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ঘটনা ঘটে। পরে ডিবি পুলিশের হস্তক্ষেপে ওই টাকা ফেরত পান ভুক্তভোগীরা। তবে এসব দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।


এনসিটিবিতে দুর্নীতি

পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে প্রেস মালিক ও এনসিটিবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির মহোৎসব ঘটে বিগত সময়ে। নিম্নমানের বই দিয়ে অতিরিক্ত লাভ করতেই এসব দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হতো। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ উঠলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। শুধু ছাপা নয়, পাঠ্যবই লেখা ও সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের নিয়েও বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে অধ্যাপক জাফর ইকবালের লেখা বইয়ে বিদেশি তথ্য নকলের দায়ে ক্ষমা চাওয়ার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এছাড়া ইতিহাস বিকৃতি ও ইসলামবিরোধী ও বিতর্কিত বিভিন্ন বিষয় পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এনসিটিবির এক কর্মকর্তা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠানটি থেকে গোপনে একটি শ্বেতপত্র তৈরি করে সরকারকে দেওয়া হয়। তবে তা ছিল দায়সারা। বরং এতে অভিযুক্তদের রক্ষা করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি প্রায় অর্ধশত আওয়ামী দোসর প্রেস মালিকের দুর্নীতির বিষয় দুদক খতিয়ে দেখছে বলে জানা গেছে। এছাড়া এনসিটিবি থেকে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।


উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি

দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ব্যাপক দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাই এসব দুর্নীতিতে অঘোষিতভাবে নেতৃত্ব দিতেন। প্রশাসনিক পদে দলীয়করণ, শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের প্রশ্রয়, ফ্যাসিবাদী সরকারের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান ও বিরোধীদের হেনস্তাসহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যায়। ঢাকা, জগন্নাথ, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চট্টগ্রাম, ইসলামীসহ প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন অস্থিরতায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

এসব অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ গ্রেপ্তার হলেও অন্য দুর্নীতিবাজরা আড়ালেই রয়ে গেছেন। একই ভাবে বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্টিফিকেট বাণিজ্য, আর্থিক দুর্নীতি, সরকারের নিয়ম লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অনিয়ম করেও সংশ্লিষ্টরা পার পেয়ে গেছেন।


মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংসের বহুমুখী ষড়যন্ত্র

মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংসে বহুমুখী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে আওয়ামী সরকার। অথচ এসব অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য মাদরাসা বোর্ড বা মন্ত্রণালয় কোনো তদন্ত করেনি। মুজিব পরিবারের সদস্যদের নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

বোর্ডটির কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ জানান, বিগত সময়ে মাদরাসার মৌলিকত্ব নষ্টের জন্য সাধারণ শিক্ষাধারার সব বই মাদরাসায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফলে মাদরাসা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আরবির গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় সংকোচন করতে হয়েছে। ক্লাস সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত সাধারণ ধারার বইয়ের সংখ্যা আট-নয়টি। মাদরাসার মাত্র চারটি বিষয়। এতে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদরাসার বিষয়াবলি সংকোচন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মাদরাসার মৌলিকত্ব নষ্ট হয়েছে। শিক্ষার্থীরা আরবিতে পর্যাপ্ত কোর্স না পাওয়ার কারণে তাতে দুর্বল হচ্ছে এবং যোগ্য আলেম তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হয়েছে।

ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ বলেন, এনসিটিবিতে মাদরাসার জন্য ১৮টি পোস্ট থাকলেও তাতে একজনও বিশেষায়িত সাবজেক্ট বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে ২০১২ সাল থেকে সত্যিকারার্থে মাদরাসার কোনো বই পরিমার্জন করা হয়নি।

জানা গেছে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুরো উপজেলার বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় নিয়োগের জন্য এমপি কাছ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এবং বিশেষ গোষ্ঠী ডাক নিত। কোটি টাকার ডাক নিয়ে পরে এক বছরে তিনি শিক্ষক নিয়োগ দিতেন জনপ্রতি ৮-৯ লাখ টাকা নিয়ে। এভাবে চার-পাঁচ কোটি টাকা লাভ হতো নেতাদের।

সূত্রমতে, মাদরাসা অধিদপ্তরের নিয়োগে বিধিমোতাবেক বিশেষজ্ঞ হিসেবে যাওয়ার কথা তিনটি সরকারি আলিয়া মাদরাসার গেজেটেড কর্মকর্তা, বিএমটিটিআই এবং অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। কোনো বেসরকারি মাদরাসা থেকে অধ্যক্ষদের এ নিয়োগে এক্সপার্ট হিসেবে যাওয়ার সুযোগ নেই। স্বাধীনতা শিক্ষক ফোরামের নামে আওয়ামী সংগঠন থেকে চার-পাঁচ ব্যক্তি এ নিয়োগে যেতেন এবং ৮-১০ লাখ টাকা করে উৎকোচ নিতেন।

শিক্ষা খাতের দুর্নীতি প্রসঙ্গে আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিনেট সদস্য অধ্যাপক এবিএম ফজলুল করীম বলেন, পতিত আওয়ামী সরকার প্রথম হাত দেয় শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার কাজে। কারণ কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে আগে শিক্ষাব্যবস্থা ও নৈতিকতাকে ধ্বংস করতে হয়। আওয়ামী সরকারের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ২০১০ সালে যে শিক্ষানীতি করেছিলেন, তা পুরোপুরি নৈতিকতা ও চরিত্রহীন শিক্ষার্থী তৈরির জন্য সাজিয়েছিলেন। পরে যে বিতর্কিত কারিকুলাম চালু করা হয়েছিল তাতে স্কুলজীবনেই প্রেম-ভালোবাসা শিখত জাতি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ওই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বাঁচার সুযোগ পেয়েছে দেশ।

এবিএম ফজলুল করীম বলেন, দেশকে ভালো করতে চাইলে শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাহলে ১০ বছর পর আমরা ভালো মানুষ পাব। বিগত সময়ে শিক্ষা খাত ধ্বংসের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব শিক্ষামন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবের বিচার করতে হবে। অন্যান্য বিচারের সঙ্গে এই বিচারও জরুরি।

গত ১৫ বছরে শিক্ষা খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আমানুল্লাহ বলেন, সব জায়গায় বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্টে দুর্নীতি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বের হতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে একটি আর্থিক তদন্ত চলছে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.