নৌকায় এসি-সুইমিং পুল, জলে মলমূত্র: কতটা পরিবেশবান্ধব হাওরের পর্যটন
পর্যটক ও পর্যটন ব্যবসায়ীদের পরিবেশ-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে বিশাল এই জলরাশিতে বাড়ছে দূষণের মাত্রা; যা প্রভাবিত করছে সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণ-বৈচিত্র্যকে।
ভরা বর্ষায় আষাঢ়ী পূর্ণিমায় সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে গিয়েছিলেন আইনজীবী সাঈদ আহমদ। তারা প্রায় ৩০ জন একসঙ্গে একটি হাউস বোট ভাড়া করে সেখানে যান। পাহাড়-প্রকৃতি-জলরাশি মুগ্ধ করলেও সাঈদ সিলেট ফেরেন চর্মরোগ নিয়ে।
হাওরের পানিতে সাঁতার আর গোসলের কারণে তার চুলকানি শুরু হয় বলে চিকিৎসক তাকে জানিয়েছেন। এজন্য তাকে নিয়মিত ওষুধও সেবন করতে হয়েছে।
সাঈদ বলছিলেন, “ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় পানিতে নেমে কিছু সময় সাঁতার কাটার পর চুলকানি শুরু হল। দুই দিন চুলকানি ছিল। আমার মনে হয়, দূষণের কারণে পানি খারাপ হয়ে গেছে। বড় বড় হাউস বোটগুলো চলে আর বোটগুলোতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের সবকিছু পানিতে ফেলে দেয়।
“রাতের বেলাও হাওরে বোট চলতে দেখেছি। এ রকম বেশিদিন চললে হাওরের সুন্দর পরিবেশ নষ্ট হবে। তবে হাওরের সৌন্দর্য দেখে খুব ভালো লেগেছে। আমাদের সিলেট অঞ্চলে এই হাওরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই হাওরটির পরিবশে রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।”
দিনে দিনে হাওরের পর্যটন যেমন জমে উঠছে, তেমনি পর্যটক ও পর্যটন ব্যবসায়ীদের পরিবেশ-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে বিশাল এই জলরাশিতের বাড়ছে দূষণের মাত্রা; যা প্রভাবিত করছে সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণ-বৈচিত্র্যকে।
নিবিড়-শান্ত পাহাড়-প্রকৃতি আর শীতল জলরাশির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে আসা মানুষের জন্য হাউস বোটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), সুইমিং পুল, সাউন্ড বক্সে বিকট শব্দে গান-বাজনার আয়োজন, মাছ-পাখির সংরক্ষিত এলাকায় অবাধে বিচরণ পরিবেশের জন্য কতটা স্বাস্থ্যসম্মত হচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠছে।
স্থানীয় প্রশাসন কিছু নীতিমালা তৈরি করে দিলেও তাতে একেবারেই গা করছেন না পর্যটক ও পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, দূষণ আর পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে হাওরের বিপদ বাড়বে।
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের ৪১টি গ্রামের জেলেদের নিয়ে গঠিত টাঙ্গুয়ার হাওর কেন্দ্রীয় সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহম্মদ কবির বলেন, “ইদানিং আমরা দেখতে পাচ্ছি, হাওরে আসা পর্যটকরা উচ্ছিষ্ট খাবার, মলমূত্র, প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন জলে ফেলছেন। এতে পরিবেশ ও মাছের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
“নিয়ম ভেঙে কয়লা ও পাথরবাহী বড় বড় নৌকা চলছে রাতের বেলা। ফলে সরকার ঘোষিত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ উন্নয়নের বদলে সেটি এখন হুমকিতে রয়েছে।”
অবস্থান-প্রকৃতি
সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে নয় হাজার ৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার আর বাকি অংশ গ্রাম ও কৃষিজমি।
শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে এখানকার প্রায় ২৪টি বিলের পাড় (স্থানীয় ভাষায় ‘কান্দা’) জেগে ওঠে। তখন শুধু ‘কান্দা’র ভেতরেই ‘মূল বিল’ থাকে। এই বিলে আসে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। তখন হাওর অন্য এক রূপে আবির্ভূত হয়। আর শুকিয়ে যাওয়া অংশে কৃষক রবিশস্য ও বোরো ধান আবাদ করে।
বর্ষার টইটুম্বুর হাওর, সবুজ পাহাড়, মাথার উপর মেঘের ছায়া- সব মিলিয়ে অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। তাই টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের ঢল নামে বর্ষাকালে। পর্যটকরা এখানকার শিমুলবাগান, যাদুকাটা নদী, বড়গোফ টিলা-বারিকটিলা, শহীদ সিরাজ লেক ও লাকমাছড়াতেও ঘুরে বেড়ান।
২০০৩ সাল থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। একজন নির্বাহী হাকিমের নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন।
দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারি প্রথা বাতিল করে ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে ‘রামসার সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইসিইউএন এই হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছে।
শত শত হাউস বোটের দাপট
সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে দেখা গেছে, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত কয়েকশ বড়-ছোট হাউস বোট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বেশিরভাগ কাঠের তৈরি হলেও কিছু কিছু নৌকায় স্টিলের কাঠামোও দেখা গেছে। এর পাশাপাশি দেখা গেছে পণ্য পরিবহনের ভারী যানবাহন।
পর্যটকদের হাউস বোট বেশ সাজানো-গোছানো। ঝকঝকে কক্ষ, কেবিন। দিনের বেলা পর্যটকরা জানালা দিয়ে জলের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারেন। ভেতরে সোফায় বসে গল্প করার জায়গাও আছে। কেবিনে ফ্যান, সাউন্ড সিস্টেম অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস রয়েছে।
বোটগুলোর সামনে আর ছাদে আছে দোলনা; কৃত্রিম সবুজ ঘাসের আচ্ছাদন। ছাদের উপরে বসার জন্য চেয়ার-টেবিল, সোফা সবই আছে। নানা জাতের গাছ আছে টবে সাজানো।
চারপাশে বাতাসের অভাব না থাকলেও বেশ কিছু হাউস বোটে কেবিনপ্রতি এসির ব্যবস্থা আছে। জলে-ভাসা নৌকার ছাদে ছোটখাট সুইমিং পুলও দেখা গেছে।
রান্নার জন্য প্রতিটি নৌকায় গ্যাস সিলিন্ডার অবধারিত। রাতের বেলা আলোকসজ্জার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে কিছু নৌকায়।
মালিকদের ভাষ্য, হোটেলের সব সুবিধাই তারা নৌকায় দিতে চান।
জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী, রাতের বেলা পর্যটকবাহী হাউস বোটগুলো তাহিরপুর উপজেলা সদর বা টেকেরঘাট এলাকায় নোঙর করার কথা। তবে অনেক হাউস বোটকে পর্যটক নিয়ে যাদুকাটা নদীর শিমুলবাগান, মিয়ারচর, রক্তি নদীর তীরবর্তী আনোয়ারপুর ও বালিজুরি ঘাটে নোঙর করতে দেখা গেছে।
টাঙ্গুয়ার হাওর হাউস বোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরাফাত আকন্দ বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে ২০ লাখ থেকে শুরু করে এক কোটি টাকা দিয়ে তৈরি হাউস বোট রয়েছে। প্রতিটি হাউস বোট পরিচালনা করতে ছয় থেকে ১২ জন লোক লাগে। আনুমানিক ১৪টি হাউস বোটে এসির ব্যবস্থা আছে।
“আর সুইমিং পুল বলতে এগুলো বেবিপুল। এগুলো মূলত বাচ্চাদের জন্য, যারা পানিতে নামতে চায় না। তবে অনেক সময় বড়রা দুষ্টমি করে বেবিপুলে নেমে যান।”
তিনি বলেন, “ভিআইপি কাস্টমার যারা আসেন, তাদের চাহিদা অনুযায়ী হাউস বোটগুলো তৈরি করা হয়েছে। আর যারা বিনিয়োগ করেন তাদের বিনিয়োগ তুলতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। তবে এ বছর প্রচুর পর্যটক আসছেন টাঙ্গুয়ার হাওরে। দেশের লোক দেশে ঘুরবে, দেশের টাকা দেশে থাকবে, এটাই তো ভালো।”
ব্যবসা কত বড়
তাহিরপুর উপজেলা নৌ-পর্যটন শিল্প ও সমবায় সমিতির সভাপতি মো. রব্বানী বলেন, তাদের সমিতিতে বড় আর ছোট মিলে ১১৮টি হাউস বোট রয়েছে। সুনামগঞ্জের আছে ৯০টি হাউস বোট, তাদের আলাদা সংগঠন আছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে নেত্রকোণা, ঠাকুরাকোণা, মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা, ধর্মপাশা, মধ্যনগর, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর ও সুনামগঞ্জ থেকে পর্যটক নিয়ে আসে হাউস বোট। সব মিলিয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ বড়-ছোট হাউস বোট রয়েছে। এর মধ্যে শুক্র ও শনিবার ৪০০ থেকে ৫০০ বোট যাতায়াত করে।
রব্বানী দাবি করেন, “প্রতিদিনই টাঙ্গুয়ার হাওরে যাত্রী নিয়ে আসা-যাওয়া করছে হাউস বোট। বর্তমানে হাউস বোট ‘ওয়াচ টাওয়ার’ এলাকায় যায় না। নদী থেকে হাতে বাওয়া নৌকা দিয়ে পর্যটকরা ‘ওয়াচ টাওয়ার’ এলাকায় যান। আমরা হাওর এলাকায় ময়লা ফেলতে দিই না, প্রশাসনও এ বিষয়টি নজরদারি করছে।”
টাঙ্গুয়ার হাওর হাউস বোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরাফাত আকন্দ বলেন, “জেলা প্রশাসনের অনুমোদনপ্রাপ্ত ৯৩টি হাউস বোট রয়েছে। বর্তমানে ভালো পর্যটক হাওরে আসতেছেন। আমাদের প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ ট্রিপ নিয়ে যায়। এ ছাড়া অন্য নৌকাও ট্রিপ নিয়ে যায়।
“নয়টি উপজেলা থেকে বোট আসে হাওরে, আমাদের বোটগুলো কোনো ধরনের বর্জ্য পানিতে ফেলে না। তারপরও কিছু কিছু স্থানে ময়লা বা প্লাস্টিক পড়ে থাকলে আমরা সেটি সরিয়ে নিচ্ছি। পর্যটকরা যেখানে বোট নিয়ে রাত্রিযাপন করেন, সেখানে দুই-তিন দিন পর পর আমরা পরিষ্কার করে নিচ্ছি। তবে বোট মালিক ও পর্যটকদের আরও সচেতন হতে হবে। সবাই সচেতন না হলে হবে না।”
তাহিরপুরের সদ্য বদলী হওয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হাসেম বলেন, “টাঙ্গুয়ার হাওরে চলাচলকারী বোটগুলোকে রাতে নির্দিষ্ট স্থানে থাকার জন্য অনুরোধ করা হবে। হাউস বোট, মিনি হাউস বোট, নৌকা ও ট্রলার মিলিয়ে ২০০ থেকে ২৫০টি নৌযান চলাচল করে। এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত ৯০টি বোট রয়েছে। পরিবেশবান্ধব পর্যটনের জন্য নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি রয়েছে।”
স্থানীয় নৌযান এবং হাউস বোট পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিটি বোটে প্যাকেজ হিসেবে হাওরে পর্যটকদের নেওয়া হয়। জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে শুরু করে দশ হাজার টাকার প্যাকেজ অনেকে বুক করেন। হাওরে মূলত দুই দিনের প্যাকেজ হয়।
সকালে পর্যটকরা বোটে উঠবেন, সারাদিন হাওরে ঘুরবেন। বোটগুলো যাদুকাটা নদী, শিমুলবাগান ঘুরে যায় হাওরের ‘ওয়াচ টাওয়ার’ এলাকায়। আবার কোনো কোনো বোট টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে এসে যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান এলাকায় যায়।
‘ওয়াচ টাওয়ার’ এলাকায় পর্যটকেরা হাতেচালিত বা ইঞ্জিনচালিত ছোট নৌকায় ঘুরে বেড়ান করচ গাছের বাগানের আশপাশে। তখন অনেকেই জলে নেমে সাঁতার কাটেন। এখানে দুপুরের খাবার সেরে বোটগুলো রওনা হয় হাওরের উত্তরের দিকে থাকা সবুজ মেঘালয় পাহাড়ে পাদদেশে টেকেরঘাট এলাকায়। সেখানে বোটেই রাতযাপন করেন পর্যটকরা। পরদিন আশপাশের এলাকা ঘুরে আবার হাওর থেকে ফিরে আসেন।
অনেক বোট সুনামগঞ্জ শহরের সুরমা নদীর বিভিন্ন ঘাট থেকে যায়। তবে বেশি বোট যায় তাহিরপুর উপজেলা সদরের আশপাশ ও আনোয়ারপুর বাজার থেকে। এ ছাড়া জামালগঞ্জ, মধ্যনগর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটক নিয়ে আসে বোট। প্যাকেজ ছাড়াও অনেকে পুরো বোট ভাড়া নিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার একদিনের জন্য ছোট নৌকা বা বোট ভাড়া করেন।
পর্যটনের নামে দূষণ
বোট মালিকরা স্বীকার না করলেও হাওরপাড়ের জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা নূর মিয়া বললেন, হাউস বোটের বর্জ্য পানিতে ফেলা দেওয়া হয়। ঘুরতে আসা লোকজন পানিতে সাঁতার কাটে, হাওরে নেমে চিৎকার করে।
“আমরা হাওরপাড়ের লোকজন এই পানি ব্যবহার করি। অনেক সময় দেখা যায়, পানিতে মানুষের মলমূত্র ও ময়লা-আবর্জনা ভাসছে। আমাদের বাধ্য হয়ে এই পানিই ব্যবহার করতে হয়।”
টাঙ্গুয়ার হাওর কেন্দ্রীয় সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহম্মদ কবির বলেন, শুক্রবার হাউস বোটসহ অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ নৌকা পর্যটক নিয়ে আসে। টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের ক্ষেত্রে পর্যটকদের অব্যশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে জীববৈচিত্র্য ক্ষতি না হয়।
কয়েক বছরের জন্য হাওর ‘লকডাউন’ করা গেলে হয়ত আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে বলে মনে করেন পাঠাবুকা গ্রামের বাসিন্দা রিপছান হাবীব।
তিনি বলেন, “হাওরের পানিতে প্লাস্টিকের বোতল, গ্লাস, ওয়ান টাইম প্লেইট, মদের বোতল ভাসতে দেখা যায়। আপনি এলে দেখতে পারবেন। হাওরের বাঁধগুলোর কাছে পানিতে ভেসে থাকে এসব।”
মাছের বিচরণে বাধা
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ডু বলেন, “হাউস বোটগুলো যখন চলছে তখন পানিতে প্রচুর এজিটেশন (আলোড়ন) হচ্ছে। মলমূত্র সরাসরি পানিতে ফেলছে। বর্জ্যের কারণে পানি এবং পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। মাছের বিচরণ এবং বসবাস বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে।
“অথচ এই কাজটা আমরা দেশীয় নৌকার মাধ্যমে করতে পারতাম। হাউস বোর্ড একটি নির্দিষ্ট এলাকার পর নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। বিশেষ করে অভয়াশ্রমে এগুলো যেন না চলে।”
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় মূল পাঁচটি বিলকে স্থায়ী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, “আমার সবশেষ যে গবেষণা, সেখানে আমরা ৭৬ প্রজাতির মাছ পেয়েছি। এর আগে ২০২২ সালে ৯৩ প্রজাতি পেয়েছিলাম। এটাও কিন্তু একটা নির্দেশক। আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে মাছের প্রজাতি।
“আইইউসিএন ২০০৭ সালে একটা গবেষণায় দেখিয়েছে, ১৪১ প্রজাতির মাছ আছে। তার মানে অনেক অল্প সময়ের ভিতরে ব্যাপকভাবে কিন্তু এই মাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ প্রজাতির মাছ সারাদেশে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। বাকি মাছগুলো খুব দুর্লভ।”
প্রশাসনের নির্দেশনা
হাওরে পর্যটকদের ব্যবহৃত নৌযানের জন্য কিছু নির্দেশনা জারি করেছে জেলা প্রশাসন; যাতে পরিব্শে দূষণ কমানো যায়। যদিও এসবের তদরকির জন্য পর্যাপ্ত কোনো জনবল নেই। মাঝে মাঝে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করা কিংবা নামমাত্র জরিমানা করা হয়।
প্রশাসনের নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- প্রশাসন নির্ধারিত নৌপথ ব্যবহার; পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার; স্থানীয় গাইড ও পরিষেবা গ্রহণ; প্লাস্টিক পণ্য বর্জন; দূর থেকে পাখি ও প্রাণী পর্যবেক্ষণ; ‘ক্যাম্প ফায়ার’ বা আগুন জ্বালানো থেকে বিরত থাকা; হাওরে উচ্চশব্দে গান-বাজনা না করা বা শোনা; হাওরের পানিতে অজৈব বা প্লাস্টিক-জাতীয় পণ্য ও বর্জ্য না ফেলা; মাছ ধরা, শিকার বা পাখির ডিম সংগ্রহ না করা ও পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে কোনো ধরনের বিঘ্ন না ঘটানো; ডিটারজেন্ট-শ্যাম্পু বা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করা; গাছ কাটা, গাছের ডাল ভাঙা বা বনজ সম্পদ সংগ্রহ না করা; হাওরে সংরক্ষিত (কোর জোন) অংশে প্রবেশ না করা এবং মনুষ্যসৃষ্ট বর্জ্য হাওরে না ফেলা।
প্রশাসন যা বলছে
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে চলাচলকারী বোটগুলোকে পর্যটন করপোরেশনের আওতায় লাইন্সেস দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াও যদি কেউ পরিবেশ দূষণ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে বোটগুলোর চলাচল মনিটরিং করা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলা প্রশাসন মিলে এই নজরদারির কাজটি করছে। বোটগুলোকে সর্তক করা দেওয়া হয়েছে যেন হাওরের মূল বিলে প্রবেশ না করে। এছাড়া নেত্রকোণা থেকে আসা বোটগুলোকে সর্তক করা হয়েছে, যাতে মূল বিলে দিয়ে চলাচল না করে। পরিবেশ দূষণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন চেয়ারম্যান সায়েমা শাহীন সুলতানা বলেন, “নৌকা চলাচলের ব্যাপারটি ট্যুরিজম বোর্ড আর মন্ত্রণালয়ের বিষয়। এটি পর্যটন করপোরেশন কাজের মধ্যে পড়ে না।”
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবেরের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
No comments