মানুষ হিসেবে নারীর যোগ্যতার মূল্যায়ন হোক
বাংলায় মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া আজ বেঁচে থাকলে খুশি হতেন এটা দেখে যে, তার জ্বালানো শিক্ষার নিভু নিভু মোমের আলোয় বাংলার মুসলিম নারী যে যাত্রা শুরু করেছিল, তা আজ দৃপ্ত মশাল হয়ে চারদিকে আলোর বিকিরণ ছড়াচ্ছে আর সে আলোর আভায় উদ্ভাসিত হচ্ছে চারদিক।
কোথায় নেই বাংলার নারী! রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ অলংকৃত করা থেকে শুরু করে প্রশাসনের প্রতিটি পর্যায়ে এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিচারব্যবস্থা, আইন পেশা ও বিজ্ঞান গবেষণায় পুরুষের সঙ্গে দৃপ্ত পদব্রজে সমান তালে এগিয়ে চলেছে বাংলার নারী।
বিমান চালনা থেকে শুরু করে ট্রেন চালনা, এমনকি বর্তমান কালের যানজটে নাকাল শহরের বাসিন্দাদের যাতায়াত সহজ করতে রাইড শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রেও নারী ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত পোশাকশিল্পে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন নারী। হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়াসহ পৃথিবীর সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছে বাংলার নারী। প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে শুরু করে পুলিশ বাহিনী, এমনকি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতেও নারীর অংশগ্রহণের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা অনস্বীকার্য।
দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় বাংলার নারীর অংশগ্রহণ এখন অতিসাধারণ ব্যাপার। শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিতে নয়, বাংলাদেশের গণ্ডি পার হয়ে ইউরোপ, আমেরিকাসহ অন্যান্য অনেক উন্নত দেশের রাজনীতি এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে বাংলার নারী। এককথায়, বাংলার নারী আজ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আসীন। যখন দেখি বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিরক্ষর হতদরিদ্র নারী নিজ চেষ্টা আর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের অবস্থান বদলে উদ্যোক্তা হয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তার পদক গ্রহণ করে, তখন মনটা গর্বে ভরে ওঠে; মনে হয়, আজকের বাংলার নারীর দ্বারা সবই সম্ভব। তবে ঝকঝকে উজ্জ্বল ঝাড়বাতির আলোর ঝলকানির নিচেই রয়েছে নিকষ কালো অন্ধকার!
‘সে যুগ হয়েছে বাসী, যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো, নারীরা আছিল দাসী’
সাম্যের কবি কাজী নজরুল শত বছরেরও বেশি আগে এই কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? সে যুগ কি সত্যিই বাসী হয়েছে? নাকি আরো বেশি শক্তিমত্তা নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে নারীর জীবনকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে? যেন প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছে—‘তুমি নারী, তুমি দুর্বল, শক্তিহীন। আমি পুরুষ, আমি শক্তিমান, তুমি আমার আয়ত্তাধীন। কাজেই তোমার ওপর আমার যা খুশি করার অধিকার আছে!’
প্রতিদিনের গণমাধ্যমে নারী নির্যাতনের চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়—‘যেন নারী জন্মই আমার আজন্ম পাপ!’ নারীর প্রতি এমন কোনো ধরনের ভয়ংকর সহিংসতা নেই, যা প্রতিদিন ঘটে না—হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ, পাচার, যৌতুকের দাবিতে পিটিয়ে স্ত্রীকে হত্যা, কিংবা স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা!
এ যেন নিত্যদিনের রোজনামচা। নারী নির্যাতনের তালিকায় ইয়াসমিন, সীমা রানী, তনু, নুসরাত, মিতু, চাঁপা রানী এবং বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হীরামণিসহ নাম না জানা আরো অনেক নাম। এসব নির্যাতন এখন মানুষের যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। এসব ঘটনা ঘটলে নারী অধিকার কর্মীরা রাস্তায় নেমে কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন, কোথাও কোথাও মানববন্ধন হয়। যদিও তাতে কোনো কাজ হয় না। কয়েক দিন হইচই হয়, পত্রিকার রিপোর্টাররা দৌড়াদৌড়ি করে ছবি তুলেন। সে ছবি পরের দিন পত্রিকায় ছাপা হয়। তারপর যে তিমিরে সেই তিমিরেই এসব ঘটনা চাপা পড়ে যায়। এসব অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়। নুসরাতের মতো সৌভাগ্য হলে দ্রুত বিচার আইনে অপরাধীদের দণ্ড দেওয়া হয়। নয়তো মামলা বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। অপরাধের শিকার নারীর পরিবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে কয়েক বছর গলদঘর্ম হয়ে আদালতের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়। তারপর হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, আর বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কেঁদেই চলে।
অপরাধ নাকি সভ্যতার অবদান। আর সেই অদ্ভুত সভ্যতা মনে হয় শুরু হয়েছিল নারীকে নির্যাতন করার মধ্য দিয়ে। গ্রিক সভ্যতার সময়ে নগররাষ্ট্রে দাস এবং নারীকে নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো না। এই দুই শ্রেণির মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের কোনো সুযোগ ছিল না। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো আমেরিকার নারী ১৯২৮ সালে প্রথম ভোট প্রয়োগের অধিকার অর্জন করে। বাংলাদেশের কয়েকটি এলাকায় ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ‘ভোট দিতে গেলে স্বামীর সঙ্গে তালাক হয়ে যাবে’—এমন ফতোয়া জারি করা হতো!
ডেনমার্কের একজন মানবাধিকার কর্মী ঢাকায় এসেছিলেন বাংলাদেশে নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতনের বিষয়ে গবেষণামূলক প্রতিবেদন তৈরির জন্য। তার কাছে ডেনমার্কের নারী ও শিশুর অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানিয়েছিলেন, নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে ডেনমার্কের তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন ৫০০ নারী এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি ছয়জনে একজন নারী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। গবেষণা বলছে, অস্ট্রেলিয়ায় নারী নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, এমনকি তা সৌদি আরবকেও হার মানায়। ২০২৩ সালের ৫ এপ্রিল প্রথম আলোর একটি খবর অনুযায়ী, মেরি ল্যান্ডের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ৪৫০ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গির্জায় যৌন নির্যাতনের এক ভয়াবহ চিত্র ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে! ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে ছয় শতাধিক নারী ও শিশুকে নিপীড়নের জন্য ১৫৮ যাজককে চিহ্নিত করা হয়েছে।’ অথচ নারী নির্যাতনের তালিকায় উন্নত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নারী নির্যাতনে কুখ্যাত জেফরি এপস্টেইনের ভয়ংকর কাহিনিচিত্র কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে বেশিক্ষণ দেখা সম্ভব নয়।
একদিকে যেমন আমাদের নারীরা আজ সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিসরে নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে সক্ষমতা দেখাচ্ছে, অন্যদিকে এখনো তাদের জীবনে প্রতিদিন নেমে আসে সহিংসতা, অবহেলা ও শোষণের করাল ছায়া। এই দ্বৈত বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নারীর প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এখনো অসম্পূর্ণ। এই অসমাপ্ত লড়াইয়ে দরকার সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নারী-পুরুষের সত্যিকারের সাম্য ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা। আইন প্রয়োগের কঠোরতা যেমন জরুরি, তেমনি শিক্ষা, সচেতনতা ও মানবিকতার বিস্তারও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নারীর মর্যাদা রক্ষার লড়াই কোনো একক লড়াই নয়, এটা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। সেদিনই নারী সত্যিকার অর্থে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে, যেদিন সমাজের প্রতিটি মানুষ নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শিখবে কেবল নারী বলেই নয়, একজন পূর্ণাঙ্গ, স্বাধীন ও স্বাবলম্বী মানুষ হিসেবে।
No comments