Adsterra

লোড হচ্ছে...

গ্রামীণ উৎসবের সোনালি দিন কি তবে হারিয়েই গেল?

 

গ্রামীণ উৎসবের সোনালি দিন কি তবে হারিয়েই গেল, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Trending News, Viral News, Top News, Hot News, bangla news,bangladesh

বরিশালের বাসিন্দা আবদুল খালেক একজন কৃষক। বয়স তার আশির ঘরে। স্মৃতিচারণ করে তিনি জানান, ধর্মীয় উৎসবের বাইরে প্রতিটি উৎসবের সঙ্গে ঘরে ধান ওঠার সম্পর্ক ছিল। কার্তিকের শেষের দিকে সবুজ ধানের ডগা সোনালি হতে শুরু করে, আর পাকা ধান ওঠে অগ্রাহয়ণের প্রথম দিন।

তিনি  বলেন, “অগ্রাহায়ণের আগেই ধান পাকে, কিন্তু তোলা হয় এক তারিখে। অনেক মুসলিমপ্রধান গ্রামে আবার অগ্রহায়ণের প্রথম শুক্রবার ধান ঘরে তোলা হয়। ২০-৩০ বছর আগেও ধান তোলার দিন ঈদের দিনের মতো আনন্দ হতো।”

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ধানের আবাদ হয় বোরো মৌসুমে। কিন্তু নবান্ন উৎসব মূলত আমন ধানকেন্দ্রিক। কৃষকের কাছে বোরো ধানের চেয়ে আমন ধানের গুরুত্ব বেশি।

গ্রামবাংলার কৃষকদের জীবন নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেন মঞ্জুর হোসেন। তিনি বলেন, “আমন শব্দটি এসেছে আরবি আমান শব্দ থেকে। এই আমান মানে হচ্ছে আমানত। কৃষক বোরো ধান বিক্রি করে নগদ টাকা আয় করে, আর আমন ধান গোলা ভরে রাখে সারা বছর খাওয়ার জন্য। নতুন এই আমন ধান নিয়েই মূলত কৃষকের নবান্ন উৎসব।”

তিনি আরও বলেন, “যতদিন গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা হয়েছে, ততদিনই গ্রামে ঘরে ঘরে হয়েছে নবান্ন উৎসব। ভোরে ফজরের আজানের পরপরই দল বেঁধে কৃষকরা যেতেন ধান কাঁটতে। দুপুরের মধ্যে আটি বেঁধে ধান এনে বাড়ির উঠানে জড়ো করতেন তারা। সেই ধান গরু দিয়ে মাড়াই করত আরেক দল। ধান মাড়াই শেষ হতে রাত হয়ে যেত। তবে মাড়াইয়ের প্রথম ধাপে বিকেলের মধ্যে চাল নিয়ে মহাজনদের ঘরে রান্না হতো খিচুড়ি আর পায়েস। অনেক সময় দেশি মুরগির মাংস দিয়ে গরম ভাত।”

কয়েক দশক আগেও দেশের বেশিরভাগ কৃষকই ছিল বর্গাচাষি। নিজেদের জমি না থাকায় গ্রামের মহাজনদের জমিতে ধান চাষ করতেন। মহাজন পেতেন ধানের তিন ভাগের দুই ভাগ, আর বর্গাচাষি পেতেন এক ভাগ। ধান মাড়াই শেষে রাতে নতুন ধান নিয়ে ঘরে ফিরত কৃষক। এই ধানই ছিল কৃষকের সারা বছরের খোরাক।

কৃষকের ঘরে নবান্নের মূল আনন্দ ছিল নতুন ধানের পিঠাপুলি আর ক্ষিরসা। দেশের অনেক জেলার রীতি অনুযায়ী, অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময়ে বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর সঙ্গে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসতেন। এ সময় কৃষকের ঘরে না ছিল ক্ষুধার কষ্ট, না ছিল অভাবের তাড়না। সব মিলিয়ে সচ্ছলতার দিনগুলোই বেছে নেওয়া হতো জামাই আদরের জন্য।

নবান্নকে কেন্দ্র করে অগ্রহায়ণের শেষ ১৫ দিনে মেলা বসত গ্রামেগঞ্জে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামের মেলার বড় আকর্ষণ ছিল ঘোড়দৌড়। উত্তরাঞ্চলের মেলার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিভিন্ন ধরনের মাটি এবং পিতলের তৈজসপত্র। গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় নতুন কুপিবাতিও কিনতেন মেলায় আগত নারী-পুরুষেরা। তবে বর্তমানে এসব সুদূর অতীত।

নওগাঁর কৃষি উদ্যোক্তা মেহেদি হাসান রাজন বলেন, “কুপিবাতির দিন পেরিয়ে বৈদ্যুতিক বাতির দিন এসেছে ঠিকই, কিন্তু জ্বলতে থাকা সলতের স্বল্প আলোর দিনগুলোর নবান্নের আনন্দ এখন আর নেই। এত এত আলোর মাঝেও সুন্দরতম দিনের খোঁজে ফিরে তাকাতে হয় স্বল্প আলোর অতীতের দিকে।”

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, নবান্নের উৎসব এখনো অনেক গ্রামে হলেও আগের সেই সর্বজনীন আনন্দ নেই। নওগাঁর নাজিরপুরের পদ্মপুকুরের শত বছরের নবান্ন মেলা এখনো টিকে থাকলেও হারিয়ে গেছে তার অতীতের জৌলুস।


যাত্রাপালা ও পুথি গান

অগ্রাহয়ণের পর পৌষের শীতে গ্রামে গ্রামে বিশেষ আয়োজন ছিল যাত্রাপালার। তখন কৃষকের হাতে সদ্য ওঠা ধান থাকায় কিছুটা ধান বিক্রি করে পরিবার নিয়ে যাত্রা দেখার আনন্দ ভাগাভাগি করত কৃষক।

সাধারণত কয়েক গ্রাম মিলিয়ে বড় বড় যেসব গঞ্জ গড়ে উঠত, সেখানে আয়োজন হতো যাত্রাপালার। তবে অবস্থাসম্পন্ন মহাজনরা নিজ উদ্যোগে বাড়ির বড় উঠান কিংবা এলাকার মাঠে যাত্রাপালার আয়োজন করতেন।

চট্টগ্রামের বাসিন্দা আবদুস সোবহান বলেন, “সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়েদের পক্ষে গঞ্জে গিয়ে যাত্রা দেখা ছিল অসম্ভব। সেসব পরিবারের ছেলেদের বেলায়ও ছিল নানা রকম বিধিনিষেধ। তবে আনন্দ থেকে যাতে কেউ বঞ্চিত না হয়, তাই নিজ উদ্যোগে আয়োজন হতো যাত্রাপালার। সে সময়ে গ্রামে বিদ্যুৎ নেই, টিভি নেই; ব্যাটারিতে চলতো রেডিও, তাও হাতেগোনা কয়েকজনের ঘরে ছিল এই বেতার যন্ত্র। যাত্রাপালা ছিল মানুষের বিনোদনের সর্বোচ্চ মাধ্যম। নবান্নের আমেজ কাটতে না কাটতেই শুরু হতো এই যাত্রাপালা।”

অন্যদিকে, বাংলা সাহিত্যের বড় একটি অংশজুড়ে আছে পুথি সাহিত্য। পুথি সাহিত্যের উদ্ভব মূলত মানুষের মুখে মুখে। কমলা সুন্দরী, লাইলি-মজনু, সোহরাব-রুস্তম, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ— এসবের বেশিরভাগ কাহিনী বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়ার প্রধান মাধ্যম ছিল পুথি গান।

ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, জামালপুরের মতো জেলায় পুথি সাহিত্যের কদর ছিল দারুণ। শীতের দিনে বড় উঠানের মাঝে পাটি বসিয়ে সুর দিয়ে পুথি পড়তেন একজন, আর তাকে ঘিরে বসত বাড়ির সব পুরুষেরা। মেয়েরা সাধারণত বসতেন ঘরের দুয়ারে কিংবা পাটাতনে। গভীর রাত পর্যন্ত চলত পুথিপাঠ।

ময়মনসিংহের বাসিন্দা ফরিদা বেগম নিজের শৈশবের কথা স্মরণ করে বলেন, “এক দিনে পুরো পুথির কাহিনি শেষ হতো না। সবার মাঝে উত্তেজনা থাকত এরপর কী হবে। পুথি শুনে মা-খালাদের চোখ বেয়ে আবেগে অশ্রু বেয়ে পড়ত। গ্রামের সহজ-সরল মানুষেরা ভাবতেন, এ পুথির কাহিনী বুঝি সত্যি।”

তিনি আরও বলেন, “হিন্দু পাড়ায় কীর্তন আর কবিগানের আয়োজন হতো। অন্য গ্রাম থেকে গান করতে শিল্পীদের ভাড়া করে আনা হতো। কবিগানের প্রতিযোগিতা চলতো শেষ রাত পর্যন্ত।”

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে যাত্রাপালা, পুথি গান, কীর্তন আর কবিগান। গ্রামের সন্ধ্যার সঙ্গে শহরের সন্ধ্যার এখন আর প্রায় তফাৎ নেই। সব বাড়িতেই স্যাটেলাইট টিভি, হাতে স্মার্টফোন। হ্যাজাক বাতির উৎসবের দিন বিলীন হয়ে গেছে ফ্লুরোসেন্ট বাল্বের চাকচিক্যে।


হালখাতা ও নববর্ষ

মাঘের শেষের দিকে এসে কৃষকের হাতে টাকা ফুরাতে শুরু করে। কৃষক তখন দোকান থেকে ধার নিয়ে জীবন চালায়। একই সময় মাঠে শুরু হয় বোরো ধানের ফসল বোনা। ফসল ওঠার আগ পর্যন্ত কৃষকের যাবতীয় প্রয়োজন মেটে বাকির টাকায়। ব্যবসায়ীরাও কৃষকদের বাকিতে পণ্য দেন।

চৈত্রের শেষের দিকে ঘরে ওঠে বোরো ধান। এই ধান বিক্রি করে কৃষকের হাতে আসে নগদ টাকা, আর সেই টাকাতেই শোধ হয় এতদিনের দেনা। তবে যেনতেনভাবে টাকা শোধ নয়, রীতিমতো উৎসব করে হালখাতার আয়োজনের মাধ্যমে মিষ্টিমুখে এ ধারদেনা শোধ করা হতো। কৃষি অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা সমাজে হালখাতা উৎসব সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে একই মেলবন্ধনে বেঁধে রেখেছিল।

হালখাতা উৎসব প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে কুমিল্লার বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, “বাকির হিসাব রাখতে ছিল রেজিস্ট্রি খাতা। পহেলা বৈশাখ প্রতিটি দোকানে লাল মখমলের কাপড় দিয়ে সাজানো হতো এই রেজিস্ট্রি খাতা। যারা এতদিন বাকি নিয়েছেন তারা এদিন শোধ করতেন টাকা। হালখাতার জন্য অবস্থাসম্পন্ন ব্যবসায়ীরা কার্ডের মাধ্যমে দাওয়াতের ব্যবস্থা করতেন। পরিবারসমেত গঞ্জে বেড়াতে আসতেন মহাজন-কৃষকরা। শিশুদের দেওয়া হতো হাওয়াই মিঠাই কিংবা লজেন্স, আর বড়দের জন্য থাকত ছানার মিষ্টি।”

কালের পরিক্রমায় এই হালখাতা উৎসবও একরকম মিলিয়ে গেছে। বৈশাখ রূপ নিয়েছে শহুরে নববর্ষ উদযাপনে। গ্রামের বৈশাখি মেলা লুপ্ত হওয়ার পথে। হারিয়ে গেছে মাটির পুতুল, পাতার বাঁশি, কাসার তৈজসপত্র, আলতা-কাঁচের চুড়ি, আর শিশুদের বাতাসা, আমিত্তির মতো মুখরোচক সব খাবার।


গ্রাম কি আদৌ গ্রাম আছে?

গত তিন দশকে দেশের গ্রামগুলোতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। যেখানে ফসল তোলাকে কেন্দ্র করে বছরজুড়ে উৎসব চলত, সেখানে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং আর প্রযুক্তির বাহুল্যে নিজেদের হাজার বছরের সংস্কৃতি থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষ এখন অনেক দূরে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর বলেন, “বাংলাদেশের গ্রাম আগের মতো নেই, গ্রামীণ উৎসবও আগের মতো নেই। পৃথিবীজুড়ে এই ব্যাপারটি ঘটতে শুরু করেছে গত শতাব্দীর শুরু থেকেই। শিল্পের বিকাশ পুঁজিবাদি এক বিশ্ব উপহার দিয়েছে আমাদের।”

তিনি বলেন, “অতীত ঐতিহ্য আর হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য মানুষের মধ্যে এক ধরনের আকুতি বা ব্যাকুলতা সব পুরানো মানুষের মধ্যেই লক্ষ করা যায়। এ যুগে পুথিপাঠ বিলুপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ একসময় মানুষ পড়তে পারত না, শুনে তৃপ্তিলাভ করত। এখন বিনোদনের নতুন নতুন উপায় তৈরি হয়েছে, বিশেষত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। কীর্তন, কবিগান— এগুলোর জায়গায় নতুন ধরনের সংগীত হাজির হয়েছে। আর এসবের সবই স্বাভাবিক।”

তবে নবান্নের মতো উৎসব শহরে হোক বা গ্রামে এখনও মানুষকে এক করতে পারে। মেলাও তাই, সব মানুষের সম্মিলনের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। যাত্রাপালাকে নতুন যুগের উপযোগী করে উপস্থাপন করা যেতে পারে। হালখাতাকে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার প্রচারের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন বলে মত এ অধ্যাপকের।

সব মিলিয়ে যে ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাকে আবারও উদ্ধার করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এতে করে দেশের সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হবে বলে মত তাদের।

No comments

Powered by Blogger.