Adsterra

লোড হচ্ছে...

যেমন ছিল নবীজির মক্কিজীবন

 

যেমন ছিল নবীজির মক্কিজীবন, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Trending News, Viral News, Top News

নবীজি (সা.)-এর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবুয়তের পর তার মক্কিজীবনের অধ্যায় ছিল অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। এই পর্যায়ে তিনি শুধু আল্লাহর দ্বীন প্রচারের দায়িত্বই গ্রহণ করেননি, বরং মানবসমাজে একটি নতুন জীবনব্যবস্থা কায়েমের জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করেছেন। একদিকে তিনি মানুষকে শিরক ও কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে তাওহিদের আলোয় আহ্বান জানিয়েছেন, অন্যদিকে ধৈর্য, সংযম, প্রজ্ঞা ও ক্ষমার মাধ্যমে সত্যের পথে অবিচল থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। নবুয়তের প্রাথমিক বছরগুলোতে ইসলামের দাওয়াত ছিল গোপন, সীমিত কয়েকজন বিশ্বস্ত মানুষকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ক্রমে তা প্রকাশ্যে রূপ নেয় এবং গোটা সমাজে আলোড়ন তোলে।

মক্কার পরিস্থিতি ছিল ইসলামবিরোধী ও প্রতিকূল। কুরাইশরা তাদের বংশগত অহংকার, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং মূর্তিপূজাভিত্তিক সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। ফলে তারা মুহাম্মদ (সা.) ও তার সাহাবিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালাতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। সামাজিক বয়কট, প্রাণনাশের হুমকি, শারীরিক নির্যাতন এবং অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সবকিছুর মধ্যেও নবীজি (সা.) অটল ছিলেন। তিনি তার অনুসারীদের ধৈর্য ও স্থিরতা শেখাতেন, আল্লাহর প্রতি আস্থা দৃঢ় রাখতে বলতেন।

একই সঙ্গে নবীজি (সা.) ইসলামের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তোলার কাজও চালিয়ে যান। দারুল আরকামে সাহাবিদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি এমন একটি দল প্রস্তুত করেন, যারা শুধু দ্বীনের জ্ঞানেই সমৃদ্ধ নয়, বরং আদর্শবান, দৃঢ়চেতা ও নৈতিকতায় উত্তম ছিল। ধাপে ধাপে তিনি তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাতের বিশ্বাস স্থাপন করান, কুসংস্কার ও সামাজিক জুলুমের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করেন। কুরাইশদের অনমনীয় বিরোধিতা দেখে তিনি মক্কার বাইরে বিকল্প জনগোষ্ঠীর দিকে নজর দেন। হাজিদের মধ্যে দাওয়াত, পার্শ্ববর্তী বাজার ও গোত্রে ইসলামের বার্তা পৌঁছানো এবং মদিনায় ইসলামের জন্য ভিত্তি তৈরি করা, সবই ছিল তার সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনার অংশ।

মক্কিজীবনের এই অধ্যায় ছিল ধৈর্য, প্রজ্ঞা, কৌশল এবং দৃঢ় নেতৃত্বের এক মহত্তম দৃষ্টান্ত। এখানেই রচিত হয়েছিল ইসলামের সেই ভিত্তিপ্রস্তর, যার ওপর দাঁড়িয়ে পরবর্তী সময়ে মদিনায় গড়ে ওঠে শক্তিশালী ইসলামি রাষ্ট্র। নবীজি (সা.)-এর এই কর্মপন্থা আজও দাওয়াতি কার্যক্রম, নেতৃত্ব ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্য চিরন্তন পথনির্দেশক হয়ে আছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো।

দাওয়াতের নীতি : মক্কায় মহানবী (সা.)-এর দাওয়াতি কার্যক্রম কয়েকটি মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এক. প্রজ্ঞার সঙ্গে দাওয়াত। মক্কিজীবনে মহানবী (সা.) দাওয়াতি কার্যক্রমে সর্বোচ্চ প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তিনি এমন একটি কৌশল অবলম্বন করেন, যেন ইসলামের দাওয়াত অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে না যায়। দুই. ক্ষমা ও উপেক্ষা করা। সব বাধা উপেক্ষা করা এবং সব অবিচার ক্ষমা করে দেওয়ার নীতি অবলম্বন করেই মহানবী (সা.) ও সাহাবিরা মক্কায় দ্বীনি দাওয়াত দেন। যেমনটি আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষমা করো এবং উপেক্ষা করো যতক্ষণ না আল্লাহ তার বিধান দান করেন।’ (সুরা বাকারা ১০৯) তিন. ধৈর্য ও উত্তম প্রতিবিধান। মক্কিজীবনে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেন এবং তারা মন্দের প্রতিদান ভালো দ্বারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 

নবীজির কর্মকৌশল : নবীজি (সা.) নবুয়ত লাভের পর মক্কায় যেভাবে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, তা শুধু তাত্ত্বিক শিক্ষাই নয়, বরং বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য এক সুস্পষ্ট কর্মপন্থা। কঠিন প্রতিকূলতা, সীমাহীন বিরোধিতা এবং সামাজিক বয়কটের মধ্যেও তিনি যে ধৈর্য, কৌশল ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করেছেন, তা আজও মুসলিম উম্মাহর জন্য পথনির্দেশক। তার কর্মপন্থার কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো।

গোপনে দাওয়াত : নবুয়তের সূচনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম তিন বছর দাওয়াত দেন গোপনে। এ পর্যায়ে তিনি সর্বপ্রথম তার নিকটাত্মীয়, বন্ধু ও বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের ইসলামের দিকে আহ্বান করেন। এতে একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠে এবং প্রথম দিকের সাহাবিরা ছিলেন এই ভিত্তির স্তম্ভস্বরূপ। এই গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র কাফেলা প্রস্তুত করেন, যারা পরবর্তী সময়ে ইসলামের দাওয়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

প্রকাশ্যে দাওয়াত : তিন বছর পর রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রকাশ্য দাওয়াত শুরু করেন। আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তিনি দাওয়াতে নিজের পরিবার ও গোত্র কুরাইশকে বেছে নেন। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।’ (সুরা শুআরা ২১৪-১৫) কেননা গোত্রের লোকেরাই তার সততা, বিশ্বস্ততা ও নৈতিক গুণাবলি সম্পর্কে অধিক অবগত ছিল। এ ছাড়া তিনিও তাদের কাছ থেকে অধিক সহনশীল আচরণ আশা করেন।

ধৈর্য ও সংযম অবলম্বন : মক্কার কুরাইশরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর নানা রকম নির্যাতন চালায়। তাকে ও সাহাবিদের গালাগাল, শারীরিক আক্রমণ, সামাজিক বয়কট ও প্রাণনাশের হুমকির মুখে পড়তে হয়। কিন্তু তিনি কখনো পাল্টা আক্রমণ করেননি বা প্রতিশোধের পথে যাননি, বরং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে ধৈর্যধারণ করতেন এবং সাহাবিদেরও সংযত থাকতে বলতেন। সবর ও তাওয়াক্কুলের শিক্ষা ছিল তার এই মক্কিজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা কার্যক্রম : মক্কিজীবনে রাসুল (সা.) গোপনে ছোট ছোট দলে সাহাবিদের ইসলামি শিক্ষা ও আখলাক গঠনের কাজ করেন। এর জন্য তিনি সাহাবি আরকাম ইবনে আবুল আকরাম (রা.)-কে বেছে নেন। যা ইতিহাসে ‘দারুল আরকাম’ হিসেবে পরিচিত। এই শিক্ষাকেন্দ্রে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা, কোরআন শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের কাজ চলত। এই গোপন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ছিল পরবর্তী সময়ের বৃহৎ ইসলামি রাষ্ট্রের প্রাথমিক ট্রেনিং সেন্টার। এর দ্বারা বোঝা যায়, কোনো আন্দোলনের সফলতার জন্য শুধু সংখ্যাগত বৃদ্ধি নয়, বরং আদর্শবান, শিক্ষিত ও পরিশীলিত কর্মী প্রস্তুত করা গুরুত্বপূর্ণ।

ধারাবাহিক অগ্রগতি : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কর্মপন্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ধাপে ধাপে কাজ করা। প্রথমে তিনি তাওহিদ (একত্ববাদ) প্রচারে মনোনিবেশ করেন। এরপর রিসালাত ও আখেরাতের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময়ে মহানবী (সা.)-এর ওপর ধীরে ধীরে বিধানগুলো অবতীর্ণ হতে থাকে এবং তিনি সাহাবিদের শেখাতে থাকেন।

অন্যায়ের প্রতিবাদ : যখন মুসলমানের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেল এবং ইমানের মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো হয়ে গেল, তখন নবীজি (সা.) উত্তম পন্থায় সামাজিক জুলুম, কুসংস্কার ও অপবিশ্বাসের সমালোচনা শুরু করেন। যেমন তিনি সামাজিক বৈষম্য, নারীর প্রতি জুলুম, মূর্তিপূজার অসারতা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন।

বিকল্প জনগোষ্ঠীর সন্ধান : কুরাইশরা যখন অবিরাম নবীজি (সা.)-এর বিরোধিতা করতে থাকল, তখন তিনি বিকল্প জনগোষ্ঠীর সন্ধান করেন। তিনি তার দাওয়াতি মিশনকে মক্কার বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি মক্কার পার্শ্ববর্তী বাজার ও মেলায় দ্বীনের দাওয়াত দেন, হজের সময় আগত অতিথিদের দাওয়াত দেন, পার্শ্ববর্তী গোত্র ও জনপথগুলোতে যান।

অনুসারীদের জীবন রক্ষার প্রচেষ্টা : মক্কিজীবনে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার অনুসারীদের জীবন রক্ষায় নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন। বেলাল (রা.) ছিলেন উমাইয়া ইবনে খালফের ক্রীতদাস। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে বেলাল (রা.)-এর গলায় দড়ি বেঁধে উচ্ছৃঙ্খল বালকদের হাতে তুলে দিত, তাকে নির্মমভাবে প্রহার করত, উত্তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে বুকের ওপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে রাখত। এমন কঠিন সময়েও তিনি ‘আহাদ’, ‘আহাদ’ (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক) বলে চিৎকার করতেন। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আবু বকর (রা.) তাকে কিনে স্বাধীন করে দেন। নবীজি (সা.) নবুয়তের পঞ্চম বছর সাহাবিদের হাবশায় হিজরত করার পরামর্শ দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দ্বীনি দাওয়াতের জন্য বিকল্প স্থান ও পরিবেশ প্রয়োজন। মক্কায় ইসলাম প্রসারের সম্ভাবনা কম, তখন তিনি মক্কার বাইরে দাওয়াতি কার্যক্রম জোরদার করেন। সেই ধারাবাহিকতায় মদিনায় ইসলামের সুবাতাস বইতে শুরু করে। বাইয়াতে আকাবার মাধ্যমে মদিনায় ইসলামের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল গড়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে হিজরতের পথ সুগম হয়।

No comments

Powered by Blogger.