Adsterra

লোড হচ্ছে...

অজানা পাহাড়ি জনগোষ্ঠি থেকে যেভাবে মহাশক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছিল পারস্য সাম্রাজ্য

অজানা পাহাড়ি জনগোষ্ঠি থেকে যেভাবে মহাশক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছিল পারস্য সাম্রাজ্য, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Trending News, Viral News, Top News, Hot News

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, পারসিস অঞ্চলের পার্সিয়ানরা ছিল এক অজানা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী—ইরান মালভূমির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। কিন্তু তাদের মধ্যে এক অসাধারণ নেতা আবির্ভূত হন এবং মাত্র এক প্রজন্মের মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে দখলদারি শুরু করেন। প্রাচীন রাজ্যগুলো জয় করেন, বিখ্যাত শহরগুলো লুট করেন এবং এমন একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন যা তখন পর্যন্ত বিশ্বে সর্ববৃহৎ ছিল। এই সাম্রাজ্য বিশ্বের জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশের ওপর রাজত্ব করত। পশ্চিমে বলকান ও মিশর থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্বে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই রাজবংশের শাসকেরা হতেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তাদের সম্পদ এত বেশি ছিল যে সেগুলো সীমাহীন বলেই মনে হতো। তাদের বিজয়ের গতি ও ব্যাপ্তি ছিল এতটাই বিস্ময়কর ছিল যে তারা অপরাজেয় হিসেবে পরিচিতি পায়। এই গল্পের শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৯ সালে, যখন সাইরাস দ্য গ্রেটের আবির্ভাব হয়েছিল—প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। আর এই গল্পের শেষ হয় ২৩০ বছর পরে, ম্যাসিডোনিয়ার নেতা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের হাত ধরে। যেমনটা প্রায়ই ঘটে, এই কাহিনীতেও বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কল্পনাও। তবে পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সাইরাসের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিজয় ছিল পার্শ্ববর্তী মিডস রাজ্যের রাজাকে পরাজিত করা। তিনি তার রাজত্ব বিস্তৃত করেন ইরান মালভূমি ও মেসোপটেমিয়ার বিশাল অংশজুড়ে। এরপর তিনি আক্রমণ করেন এশিয়া মাইনর যা আনাতোলিয়া নামেও পরিচিত ছিল। সেই এলাকার শক্তিশালী লিডিয়া রাজ্যকে এবং এর রাজধানী সারডিস জয় করেন। এভাবে তিনি আয়োনীয় উপকূলের অন্যান্য শহরগুলোর পথ খুলে দেন। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় জয় ছিল নিও-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান, যার মাধ্যমেই তিনি সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত ও সম্পদে ভরপুর ব্যাবিলন শহরে প্রবেশ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে তিনি শহরটি দখল করেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ইতিহাসের প্রথম রাজনৈতিক প্রচারণার একটি নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন, সেখান থেকেই এই তথ্য পাওয়া যায়। এটি 'সাইরাস সিলিন্ডার' নামে পরিচিত—একটি মাটির সিলিন্ডারে অতি সূক্ষ্ম কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা আছে কীভাবে "বিশ্বের রাজা" বিজয়ী হয়েছেন—সহিংসতা দিয়ে নয়, সহনশীলতার মাধ্যমে। সাইরাসের আদেশেই সিলিন্ডারটি ব্যাবিলন শহরের প্রাচীরের ভিত্তির নিচে মাটি চাপা দেওয়া হয়, যা ছিল ঐ অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য — যার মাধ্যমে বলা হতো 'যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ হয় এবং শাসকের শৈর্য ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ থাকে'। সেখানে বলা হয়, পূর্ববর্তী রাজা নাবোনিদাস ব্যাবিলনীয় দেবতাদের পূজায় বিকৃতি এনেছিলেন, বিশেষ করে ব্যাবিলনের প্রধান দেবতা মারদুকের এবং তিনি জনগণের ওপর জোরপূর্বক শ্রম চাপিয়ে দিয়েছিলেন। সেজন্য জনগণ ঈশ্বরদের কাছে অভিযোগ করে। তখন মারদুক একজন নায়কের খোজ করেন যিনি পুরোনো রীতিনীতি ফিরিয়ে আনবেন। এভাবেই বলা হয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের বর্ণনায়, যেখানে সিলিন্ডারটি সংরক্ষিত আছে। দেবতারা সাইরাসকে নির্বাচিত করেন, তাকে "বিশ্বের রাজা" ঘোষণা করে ব্যাবিলন আক্রমণের নির্দেশ দেন। শহরের মানুষ আনন্দের সঙ্গে সাইরাসের রাজত্ব মেনে নেয়। এরপর বর্ণনা পাল্টে যায়, এবং সাইরাস নিজেই বলেন: "আমি সাইরাস, বিশ্বের রাজা, মহারাজা, শক্তিশালী রাজা, ব্যাবিলনের রাজা, সুমের ও আক্কাদের রাজা, পৃথিবীর চার কোনার রাজা..

আরও পড়ুন ভারত থেকে যেভাবে দেশে ঢুকছে জাল নোট

"আমার বিশাল বাহিনী শান্তিতে ব্যাবিলনে প্রবেশ করে। আমি কাউকে জনগণকে ভয় দেখাতে দিইনি। আমি ব্যাবিলন ও এর পবিত্র স্থানগুলোর মঙ্গল কামনা করেছি।" সাইরাসকে দেখানো হয়েছে মারদুকের উপাসক হিসেবে, যিনি শহরে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। তিনি কেবল ধর্মীয় ঐতিহ্যই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেননি, বরং যারা নির্বাসিত হয়েছিল, তাদেরকে নিজ নিজ বসতিতে ফিরে যাওয়ার অনুমতিও দেন। "ব্যাবিলনের সমস্ত মানুষ আমার রাজত্বকে শুভকামনা জানিয়েছে এবং আমি নিশ্চিত করেছি যে সব দেশ শান্তিতে বসবাস করে।" এই বার্তা সিলিন্ডারের পাশাপাশি মাটির ফলকে লিখেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা সম্ভবত জনসমক্ষে পাঠ করা হতো। পারস্যের সেই প্রাচীন ইতিহাসে সাইরাসকে এক মহৎ, উদার শাসকের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সাইরাসের সিলিন্ডার সেই ভাবমূর্তিই গড়ে তোলে, যা বহু প্রজন্ম ধরে পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাকে সম্মানের সাথে তুলে ধরেছে। গ্রিক ঐতিহাসিক জেনোফন তার "সাইরোপেডিয়া" গ্রন্থে সাইরাসকে আদর্শ নেতা হিসেবে তুলে ধরেন এবং বাইবেলের প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ আছে যে, তিনি ইহুদিদের ব্যাবিলনীয় বন্দিত্বের অবসান ঘটিয়ে তাদের জেরুজালেমে ফেরার অনুমতি দেন। এভাবে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, তিনি হয়ে ওঠেন প্রাচীন বিশ্বের এক মহান শাসকের প্রতীক—সহনশীল, উদার, সাহসী এবং দূরদর্শী। এমনকি আধুনিক সময়েও সাইরাস সিলিন্ডারকে বলা হয়েছে মানবাধিকারের প্রথম ঘোষণা, কারণ এটি ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতার বার্তা দেয় বলে মনে করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এই ধারণাগুলো বর্তমান অর্থে প্রয়োগ হতো না। সে সময়কার সমাজ ছিল বহু-ঈশ্বরবাদী এবং বিজয়ীরা সাধারণত স্থানীয় দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে চলতেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মাতিন আরঘানদেহপুর বিবিসিকে বলেন, "প্রাচীন যুগে ধর্ম, বর্তমান সময়ের ধর্মের মতো ছিল না।" "ব্যাবিলনে অনেকে মারদুককে উপাসনা করতেন, তবে একইসঙ্গে অন্য দেবতাদেরও করতেন। তাই, ধর্মীয় স্বাধীনতা? হ্যাঁ, সাইরাস কাউকে জোর করে ধর্ম পরিবর্তন করতে বলেননি। তবে এমনটা তখন খুব একটা ঘটতও না।"


"আমি, রাজা সাইরাস, একজন আখিমেনীড"

সাইরাসের শেষ জীবন সম্পর্কে বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা নিয়েও নানা বিতর্ক আছে। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে অভিযান চালাতে গিয়ে মারা যান। হেরোডোটাস জানান, তিনি এক যাযাবর জনগোষ্ঠী জয় করতে গিয়ে মারা যান বলে প্রচলিত রয়েছে। বলা হয়, সেখানকার রানির সন্তানরা সাইরাসকে হত্যা করেছিলেন। পরবর্তীতে সেই রানি সাইরাসের মাথা সংরক্ষণ করেন। তবে হেরোডোটাস বলেন, এটি কেবল একটি প্রচলিত গল্প। সাইরাসের সমাধি ছিল পাসারগাদেতে—যেখানে তিনি তার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। তার সমাধি ছিল এক বিশাল প্রাচীরঘেরা বাগানের মধ্যে, যেখানে সবুজ গাছপালা ও প্রবাহমান জলধারা ছিল। আজ সেখানে শুধু একটি সাধারণ সমাধিই রয়ে গেছে, যা খুবই সাদামাটা। তবে এই সমাধি ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং পারস্য জাতিসত্তার পরিচয়ের প্রতীক। একটি শিলালিপিতে লেখা: "আমি, রাজা সাইরাস, একজন আখিমেনীড" যা ঘোষণা দেয় যে, এই বিশাল সাম্রাজ্য ছিল আখিমেনীয় রাজবংশের অধীনে।


আরেকজন মহামানব

সাইরাস দ্য গ্রেট পারস্য সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিলেন এবং তার পরবর্তী দুই উত্তরসূরি এটিকে আরও বিস্তৃত করেন। তবে যিনি এই সাম্রাজ্যকে সুনিয়ন্ত্রিত করেছিলেন, তিনি ছিলেন দারায়ুস প্রথম, যিনি দারায়ুস দ্য গ্রেট নামে খ্যাত। সাইরাসের পুত্র বারদিয়ার কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেণ। তিনি শাসনে আসেন এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এবং এরপর সাম্রাজ্যজুড়ে একের পর এক বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেন। মাত্র এক বছরের মধ্যেই তিনি বিদ্রোহী নেতাদের পরাজিত, বন্দি ও মৃত্যুদণ্ড দেন। পরবর্তী ৩৬ বছরের শাসনকালে আর কেউ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে সাহস করেনি। তবে তার খ্যাতি কেবল সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল না। দারায়ুস প্রকৃতপক্ষেই সাম্রাজ্যটিকে সুসংগঠিত করেন। তিনি ডাকব্যবস্থা চালু করেন, মাপ-জোখ এবং মুদ্রা ব্যবস্থার মান নির্ধারণ করেন। এত বিশাল এক সাম্রাজ্য পরিচালনার নানান প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় তিনি গোটা এলাকা ভাগ করেন প্রশাসনিক প্রদেশে, যাকে বলা হতো 'সাত্রাপি'; সেখানে কর আরোপ করেন। সবচেয়ে উচু প্রশাসনিক পদগুলোতে তিনি নিযুক্ত করেন পারস্যের উচ্চবর্গীয় অভিজাতদের মধ্য থেকে নির্বাচিত লোকদের। তিনি গোটা সাম্রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন রকম নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করেন—যেমন, মিশরে নীল নদী ও লোহিত সাগরের মধ্যে একটি খাল নির্মাণ করেন। এত বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের জন্য প্রয়োজন ছিল ভালো সড়ক ব্যবস্থা, যাতে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত থাকে। তিনি তা নিশ্চিত করেন, সড়কগুলো ছিল চমৎকার এবং দীর্ঘ যাত্রার সুবিধার্থে তৈরি করা হয়েছিল যাত্রা বিরতি। গবেষকরা বলেন, পারস্য সাম্রাজ্যের উন্নত অবকাঠামোই তাকে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। এই প্রশাসনিক মেধাই দারায়ুসকে 'দ্য গ্রেট' উপাধিতে ভূষিত করে। আর এক অতুলনীয় কীর্তি তাকে ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখে, সেটি হলো সাম্রাজ্যের গৌরবময় রত্ন: পার্সেপলিস নগরের প্রতিষ্ঠা।



পার্সেপলিস

আজও পার্সেপলিসের ধ্বংসাবশেষ দেখে বোঝা যায় এই শহরের জাকজমক এবং এই সাম্রাজ্যের গৌরব। ২০ মিটার উচু স্তম্ভসহ বিশাল টেরেসগুলো, যেগুলোর মাথায় এখনও দেখা যায় পাখি, সিংহ বা ষাড়ের মূর্তি। দেয়ালে খোদাই করা অপূর্ব অলংকরণে দেখা যায় প্রজাদের প্রতিনিধি দলগুলো রাজাকে উপহার দিচ্ছে। এই প্রতিনিধি দলগুলো ২৩টি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর, যাদের মুখাবয়ব, পোশাক-পরিচ্ছদে প্রকাশ পায় তাদের ভিন্নতা—দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত। তারা নিয়ে এসেছে সোনা, মসলা, গয়নাগাটি, হাতির দাত, পশু, যুদ্ধের অস্ত্র। তারা প্রবেশ করত "গেট অব অল নেশনস"-এর মধ্য দিয়ে—যেটি পাহারা দিতো ষাড় এবং পৌরাণিক প্রাণী লামাসু (ব্যাবিলনের ও অ্যাসিরিয়ার পৌরাণিক ষাড়-মানব), যা পারসিয়ানরাও রক্ষার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এই পারস্য শিল্প ও স্থাপত্য ছিল নানান সংস্কৃতির মিশ্রণ—বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধার নেওয়া রীতিনীতি ও শৈলীকে একসাথে করে গড়ে তোলা হয়েছিল এক অনন্য "পারসীআন" পরিচিতি। পার্সেপলিস ছিল এক রাজকীয় স্থাপত্যকীর্তি। অনেকে ধরে নেন এটি দাসদের শ্রমে তৈরি, তবে প্রত্নতত্ত্বে পাওয়া প্রমাণ তা অস্বীকার করে। আকেরেমেনীয় পারস্য সাম্রাজ্যের রাজা জার্শিসের সোনার পানপাত্র। পার্সেপলিস দুর্গ এবং রাজভাণ্ডারের ট্যাবলেট নামে পরিচিত একটি দলিল পাওয়া গেছে—মাটির তৈরি এই দলিলগুলোতে সংরক্ষিত রয়েছে তৎকালীন প্রশাসনিক তথ্য। এগুলোতে পণ্য বিনিময়, খাদ্য সরবরাহ, পশুপালন, কর্মী ও যাত্রীদের রসদ সরবরাহ—সবকিছুর বিস্তারিত হিসাব রাখা হয়েছে। এতে দেখা যায়, সাম্রাজ্যের নানা অঞ্চল থেকে মানুষ পার্সেপলিসে কাজ করতে আসতেন এবং তারা বেতন পেতেন। বর্তমান ইরানের, স্যুসায় পাওয়া একটি শিলালিপিতে দারায়ুস বলেন যে, সিংহাসনের কক্ষ নির্মাণে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন মানুষকে নির্দিষ্ট কাজ দেওয়া হয়েছিল। যেমন—আসিরিয়ানরা আনবে সিডার কাঠ, আফগানিস্তান থেকে আসবে ফিরোজা রঙ ও ল্যাপিস লাজুলি, ব্যাবিলনীয়রা তৈরি করবে ইট, আর মিশর থেকে আসবে সোনার কারিগর ও হাতির দাতের শিল্পী। এইভাবে, উপহার, কর ও কৌশলগত কাজের মাধ্যমে "চার কোণের" জাতিগুলোর সম্পদ পৌছে যেত পারস্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে। পার্সেপলিস দুই শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধ ছিল এবং পরিচিত ছিল "সূর্যের নিচের সবচেয়ে ধনী নগরী" হিসেবে। এটি কেবল স্থাপত্য নয়, শিল্প ও অলঙ্কারের মাধ্যমে তুলে ধরেছিল পারস্য সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য। সোনা-রূপায় তৈরি অসাধারণ গয়না ও অলঙ্করণ তাই প্রমাণ করে। পার্সেপলিস হয়ে ওঠে এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ, বিশেষ করে তাদের জন্য, যাদের পারস্য পরাজিত করতে পারেনি; যেমন গ্রিস।


একজন রাজা, যার নজরে ছিল পুরো সাম্রাজ্য

খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সালে দারায়ুস দ্য গ্রেট যখন গ্রিস জয় করতে যান, তার অভিযান শেষ হয় বিখ্যাত ম্যারাথন যুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী পরাজয়ের মাধ্যমে। এর চার বছর পর তিনি মারা যান এবং সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের দায়িত্ব পড়ে তার পুত্র জার্খসেস-এর ওপর। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালে জার্খসেস এথেন্স দখল করলেও, তার বাহিনী গ্রিকদের কাছে একাধিক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়; সমুদ্রে সালামিস, ভূমিতে প্লেটাইয়া ও মাইকালে পরাজিত হন। শেষ পর্যন্ত, জার্খসেস বুঝতে পারেন যে গ্রিস তার সাম্রাজ্যের অংশ হবে না এবং সেই আশা ছেড়ে দেন। পরবর্তী দেড় শতাব্দী ধরে পারস্য সাম্রাজ্যে চলতে থাকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ—মিশর হারানো ও পুনরুদ্ধার হয়, সাইডন (বর্তমান লেবানন) বিদ্রোহ করে এবং দমন করা হয়। এই সমস্ত সংকটের মাঝেও পারস্য বিশ্বের প্রধান শক্তি হিসেবেই থেকে যায়। ততদিনে, প্রাচীন ম্যাসিডোনিয়ায় এক রাজা আবির্ভূত হন, যার রাজসিংহাসনে বসার আগেই লক্ষ্য ছিল পারস্য সাম্রাজ্য জয়। সে লক্ষ্য নিয়েই তিনি বড় হয়েছেন। আর বাস্তবতাও ছিল—গ্রিসের এই চিরশত্রুর সম্পদ ছাড়া তার সেনাবাহিনী রক্ষা করা এবং অভিযান চালানো সম্ভব ছিল না। তিনি ইতিহাসে পরিচিত হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট হিসেবে—মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আখিমেনীয় সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেন তিনি। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে, তিনি পারস্য আক্রমণ করেন। তিনি পার্সেপলিস লুট করেন। বলা হয়, সেখান থেকে ২০০ গাড়ি বোঝাই সোনা-রূপা নিয়ে যান। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞগুলোর মধ্যে একটিশেষ , তিনি শহরটিতে আগুন ধরিয়ে দেন। কেন তিনি এমনটা করেছিলেন, তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায় না।



ধ্বংসের কারণ

ইরানিয়ান দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ আল-বিরুনি, তার গ্রন্থে "Chronology of Ancient Nations" (খ্রিস্টাব্দ ১০০০), এর একটি কারণ উল্লেখ করেন, যা অন্যান্য সূত্রের সঙ্গেও মিলে যায়। তিনি লেখেছেন: "[আলেকজান্ডার] পার্সেপলিস জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন পারস্যদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে। কারণ, পারস্যের রাজা জার্খসেস নাকি ১৫০ বছর আগে গ্রিক শহর এথেন্সে আগুন দিয়েছিলেন। এমনকি বলা হয়, আজও কিছু জায়গায় সেই আগুনের ছাপ দেখা যায়।" অন্যরা মনে করেন, এটি ছিল আখিমেনীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘোষণার প্রতীক। আবার কেউ কেউ বলেন, আলেকজান্ডার পারস্য সংস্কৃতি ও পরিচয় মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন—তাদের রাজাদের স্মৃতি বিলুপ্ত করে দিতে চেয়েছিলেন। যদি তাই হয়, তাহলে অনেকাংশেই তিনি সফল হন। পারস্য ইতিহাসের অনেক কিছুই ইতিহাস থেকে মুছে গেছে। শতাব্দী পরে, যখন মানুষ ধ্বংসস্তূপের মাঝে হাঁটতো এবং অদ্ভুত সব প্রাণীর মূর্তি দেখতো, তারা ভাবত এখানে আখিমেনীয় রাজারা নয় বরং রাজত্ব করতেন পৌরাণিক রাজারা। দশম শতকে, পারস্যের বিখ্যাত কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী তার মহাকাব্য শাহনামা বা "রাজাদের কাহিনি"তে এইসব পৌরাণিক গল্প স্থান দেন। তবে সেখানে সাইরাস, দারায়ুস, বা জার্খসেস—তাদের কারো নাম নেই। অথচ, এই বইটি ইরানি জাতিসত্তার বোধে একটি কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে আছে। পশ্চিমে, পারস্যের গল্প বলা হয় গ্রিক ও রোমানদের দৃষ্টিকোণ থেকে। পার্সেপলিস ধ্বংস হওয়ার পর বহু বছর ধরে অজানা ছিল এর প্রকৃত পরিচয়। ১৬২০ সালের আগে পর্যন্ত কেউ জানত না ধ্বংসস্তূপটি কী ছিল। ১৮শ ও ১৯শ শতকে বহু ইউরোপীয় ভ্রমণকারী ও গবেষক এর বিবরণ দেন। তবে ১৯২৪ সালে ইরান সরকার ড. আর্নস্ট হারৎসফেল্ড-কে এই বিশাল আখিমেনীয় প্রাসাদ চত্বরের গবেষণার দায়িত্ব দেন। তিনি ছিলেন একজন জার্মান ইরানবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ। তাঁর নেতৃত্বে পার্সেপলিসের ইতিহাস আবার উন্মোচিত হতে শুরু করে। আজ, প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও প্রাচীন দলিলের মাধ্যমে আমরা পারস্যদের নিজেদের কণ্ঠে তাদের ইতিহাস জানতে পারি—এবং সেই ইতিহাস লেখার কাজ এখনো চলছে। এই গল্প শুরু হয়েছিল সাইরাস দ্য গ্রেট- এর মাধ্যমে এবং শেষ হয় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর মাধ্যমে। এই দুই "দ্য গ্রেট" মধ্যে পারস্য সাম্রাজ্যের জন্ম, বিকাশ, মহিমা, এবং পতনের গল্প আজও মানুষকে বিস্মিত করে।

No comments

Powered by Blogger.