তুরস্কের আড্ডা ও সংস্কৃতিতে জড়িয়ে থাকা এক কাপ কফি
ইস্তানবুলের সরু গলির এক দোকানে প্রবেশ করলেই ভেসে আসে কফির সুগন্ধ। চোখে পড়ে ছোট ছোট তামার পাত্র জেজভে, যা বিশেষভাবে তুর্কি কফি বানানোর জন্য তৈরি। দোকানি ধীরে ধীরে এই পাত্রগুলো বালুর ওপর বসিয়ে কফি তৈরি করছেন। ধোঁয়া উঠছে, আরেকটু সময় গেলে তৈরি হবে ঘন কালো পানীয়, যার ওপর থাকবে হালকা ফেনা—ঠিক তুর্কি কফির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
এক কাপ কফির পাশে থাকে ছোট গ্লাসে পানি এবং মুখে মিষ্টি লাগানোর জন্য একটি টুকরা লকুম। এই কফি কেবল পানীয় নয়; এটি যেন তুরস্কের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আড্ডার অঙ্গন। প্রতিটি চুমুক যেন অতীতের গল্প, সামাজিক সম্পর্ক এবং রীতিনীতি মিশিয়ে দেয়।
ইয়েমেন থেকে ইস্তাম্বুল
কফির যাত্রা শুরু হয়েছিল ইয়েমেনে। সুফি সাধকেরা রাত জেগে প্রার্থনার শক্তি পেতেন এই পানীয় থেকে। পরে সুলতান সুলেমান ইয়েমেন জয় করলে ১৫৩৮ সালে কফি চলে আসে অটোমান সাম্রাজ্যে। খুব বেশি দেরি হয়নি, পরের বছরই তা পৌঁছে যায় আজকের ইস্তাম্বুলে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে জন্ম নেয় প্রথম কাহভেহানে বা কফি হাউস। সেখান থেকে কফি ঢুকে পড়ে অটোমানদের জীবনযাত্রায়। রাজনীতি থেকে কবিতা, প্রেম থেকে দর্শন—সবকিছুরই সঙ্গী হয়ে ওঠে কফি।
ভিন্নতার রহস্য
তুর্কি কফিকে আলাদা করে তোলে এর প্রস্তুতপ্রণালি। অন্য কফির মতো এখানে শুধু গরম পানি দিয়ে ঝটপট বানানো হয় না। এই কফি তৈরি হয় ছোট ধাতব পাত্র জেজভেতে ধীরে ধীরে রান্না করে। অনেক সময় সেই জেজভে রাখা হয় গরম বালুর ওপর, যাতে আস্তে আস্তে ফুটে গাঢ় স্বাদ তৈরি হয়। কফি তৈরির সময় ওপরে তৈরি হয় নরম ফেনা। আর এই ফেনা ছাড়া তুর্কি কফি পরিবেশন করাই অসম্পূর্ণ বলে ধরা হয়।
আড্ডা আর সম্পর্কের শুরু
তুরস্কে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে প্রথমে বলেন, ‘চলো, কফি খাই’। কারণ, সেখানে কফি সাধারণ কোনো পানীয় নয়। তুর্কি কফির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আড্ডার রীতি। তাই এই কফি তাড়াহুড়ো করে খাওয়া চলে না। তুর্কির মানুষেরা কফি পান করে ধীরে ধীরে, চুমুক দিয়ে। এতে আড্ডার আনন্দ আরও বেড়ে যায়। বিয়ের সময়ও তুর্কি কফির বিশেষ ভূমিকা থাকে। কনে হবু বরকে লবণ মিশিয়ে কফি পরিবেশন করে। যদি বর সেই কফি বিনা অভিযোগে খেয়ে নেয়, তবে এটি ধৈর্য, সহনশীলতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় হিসেবে ধরা হয়। এটি বিয়ের আগে একরকম পরীক্ষা।
বিশ্বমঞ্চে যাত্রা
তুর্কি কফি শুধু ইস্তাম্বুলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৬৫২ সালে এক তুর্কি ব্যবসায়ীর সহায়তায় লন্ডনে খোলা হয় শহরের প্রথম কফি হাউস। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কফির সংস্কৃতি। কফি হাউসগুলো ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য আড্ডার নতুন কেন্দ্র। তবে আধুনিক যুগে এসপ্রেসো, কাপাচিনো বা লাতের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবে বিশ্বজয় করতে পারেনি তুর্কি কফি। অনেকের মতে, আজও তুর্কি কফি পারিবারিক অনুষ্ঠান, বন্ধুত্বের আড্ডা ও রীতির অংশ হিসেবে রয়ে গেছে।
আজকের তুর্কি কফি
আজও ইস্তাম্বুলের অলিগলিতে খুঁজে পাওয়া যায় সেই আসল স্বাদের তুর্কি কফি। শহরের ভিড়ের মধ্যেও কিছু ছোট দোকান এখনো প্রথাগতভাবে কফি তৈরি করছে। যেখানে গেলে মনে হবে, সময় যেন থেমে আছে। স্থানীয়রা বলেন, সত্যিকারের কফি খুঁজে পেতে হলে এমন দোকান বেছে নিতে হবে, যেখানে কফি ধীরে ধীরে বালুর ওপর জেজভেতে রান্না করা হয়। কফি বানানোর সময় দোকানির যত্ন, ধৈর্য আর অভিজ্ঞতা কফির সেই পুরোনো স্বাদ এনে দেয়।
এই কফির সঙ্গে প্রায়শই পরিবেশন করা হয় এক গ্লাস ঠান্ডা পানি। এটি কফির স্বাদ পরিষ্কার করে মুখ সতেজ রাখে। আর একটি ছোট টুকরা লকুম বা তুর্কি মিষ্টি থাকে কফির পাশেই। এতে পানীয়ের তিক্ততা কমিয়ে জিবে মিষ্টি স্বাদ এনে দেয়। তুর্কি কফির এমন পরিবেশ তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আজও রয়ে গেছে।
তুর্কি কফি সংস্কৃতি ও গবেষণা সংস্থার সদস্য ওসমান সিরিমের কথায়, ‘তুর্কি কফি মানেই তুরস্কে উৎপাদিত কফি নয়। মূল বিষয় হলো কফি বানানোর পদ্ধতি। কফি কতটা ভাজা হয়েছে এবং কতটা সূক্ষ্মভাবে গুঁড়া করা হয়েছে—এটিই তুর্কি কফির আসল গুণ।’
No comments