ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিতে এল নতুন প্রশ্ন, নেতৃত্বে কে
ফিলিস্তিনিদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্ভাব্য নেতা হলেন মারওয়ান বারঘুতি। তিনি ২০০২ সাল থেকে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি রয়েছেন। সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৫০% ফিলিস্তিনি বারঘুতিকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান।
যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় বিষয়টি নতুন করে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনায় এসেছে। এর আগে ১৫৯টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেও এই তিন দেশের পদক্ষেপকে অনেকেই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। তবে এই স্বীকৃতি ফিলিস্তিনের সামনে বেশ কিছু জটিল প্রশ্ন তৈরি করেছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো— কে হবে এই সম্ভাব্য রাষ্ট্রের নেতা?
১৯৩৩ সালের মন্টেভিডিও কনভেনশন অনুযায়ী, একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য চারটি মৌলিক মানদণ্ড রয়েছে: স্থায়ী জনসংখ্যা, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, একটি কার্যকরী সরকার এবং অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতা। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে এর মধ্যে দুটি মানদণ্ড পূরণ হলেও বাকি দুটি নিয়ে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
ফিলিস্তিনে রয়েছে স্থায়ী জনসংখ্যা। তবে গাজার চলমান যুদ্ধ এই জনসংখ্যাকে বিশাল ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এছাড়া, অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে ফিলিস্তিনি কূটনীতিক হুসাম জমলতের মতো ব্যক্তিরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতা তাদের আছে।
নির্দিষ্ট ভূখণ্ডই এখন ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ফিলিস্তিনিদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা নিয়ে গঠিত হলেও, ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েল এই এলাকাগুলো দখল করে রেখেছে। পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে ভৌগোলিক বিভাজন প্রায় ৭৫ বছর ধরে চলে আসছে এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীদের উপস্থিতির কারণে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ মাত্র ৪০% ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
একটি কার্যকরী সরকার না থাকাও ফিলিস্তিনিদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনি লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রধান দল ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর থেকে ফিলিস্তিনিরা দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার দ্বারা শাসিত হচ্ছে: গাজায় হামাস এবং পশ্চিম তীরে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ— যার প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। এই রাজনৈতিক বিভাজন গত ১৮ বছর ধরে চলেছে। গাজা ও পশ্চিম তীর ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও বিভক্ত।
এছাড়া, ফিলিস্তিনে সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ও সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। এর ফলে ৩৬ বছরের কম বয়সী কোনো ফিলিস্তিনি নাগরিক কখনো ভোট দিতে পারেনি, যা বর্তমান নেতৃত্ব সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ব্যাপক হতাশা তৈরি করেছে।
এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিদের অনেকেই একটি নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন অনুভব করছেন। ৮৯ বছর বয়সী বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে অনেকেই অকার্যকর মনে করছেন। গাজার সাম্প্রতিক সহিংসতায় তার ভূমিকা অনেকটাই নীরব ছিল।
এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্ভাব্য নেতা হলেন মারওয়ান বারঘুতি। তিনি ২০০২ সাল থেকে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি রয়েছেন। সম্প্রতি তার একটি ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, এক ইসরায়েলি মন্ত্রী তাকে হেনস্তা করছে। সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৫০% ফিলিস্তিনি বারঘুতিকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান। হামাসও ইসরায়েলের কাছে বন্দি বিনিময়ের তালিকায় তার নাম রেখেছে।
গাজার সাম্প্রতিক যুদ্ধে হামাসের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেলেও, আন্তর্জাতিক মহল এবং আরব দেশগুলো স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সরকারে হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না। হামাস নিজেও একটি টেকনোক্র্যাট সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বরাবরই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হলে তা ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হবে। তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের গাজার শাসনে ফেরার বিপক্ষেও মত দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়া দেশগুলোর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই বিরোধিতার মুখেও শান্তি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি ধরে রাখা।
ফিলিস্তিনিরা এখন শুধু স্বীকৃতির প্রতীকী অর্থের চেয়ে আরো বেশি কিছু চায়। তারা চায় চলমান সংঘাত বন্ধ হোক এবং একটি সত্যিকারের কার্যকরী রাষ্ট্র গঠনের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া হোক।
No comments