জাতীয় পার্টি থেকে জি এম কাদের মাইনাস !
আবারও বড় ধরনের ভাঙনের মুখে জাতীয় পার্টি। তবে পতিত আওয়ামী স্বৈরশাসন আমলের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবার ‘মাইনাস ফর্মুলা’য় ভাঙতে যাচ্ছে।
পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরকে সরিয়ে নতুন জাতীয় পার্টি গঠনের লক্ষ্যে দলের সিনিয়র নেতারা দশম জাতীয় কাউন্সিল করছেন আগামী ২৮ জুন। এর মধ্য দিয়ে সপ্তমবারের মতো ভাঙন দেখবে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দলটি।
জি এম কাদেরকে বাদ দিয়ে যারা নতুন জাতীয় পার্টি করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তারা এত দিন কাদেরকেই ছায়া দিয়ে রেখেছিলেন। তাহলে এখন তাকে মাইনাস করা কেন?
জানা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগার ও পতিত আওয়ামী লীগের সাথে যোগাযোগের অভিযোগের পাশাপাশি দলে জি এম কাদেরের একনায়কত্ব, অহমিকায় ফুঁসে উঠেছেন সিনিয়র নেতারা।
বিশেষ করে জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, দলটির ১৭ বছর মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করা বর্তমান কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার প্রকাশ্যে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
জি এম কাদেরের অনেক ঘনিষ্ঠ নেতাসহ পার্টির সাবেক কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ সিংহভাগ শীর্ষ নেতা জি এম কাদেরকে মাইনাসের উদ্যোগে ঐকমত হয়েছেন। জি এম কাদেরকে বাদ দিয়ে নতুন করে পার্টি গঠনে তৃণমূলের সাথে যোগাযোগ রাখছেন তারা।
অবশ্য, ২৮ জুন দলটির জাতীয় কাউন্সিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন জি এম কাদেরই। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ দলটির চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন কয়েকজন সিনিয়র নেতা।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদের রানিং মেট অর্থাৎ তার প্যানেলে মহাসচিব হিসেবে নাম আসেএ বি এম হাওলাদারের।
বিষয়টি জাতীয় পার্টির জন্য গণতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে দলের অন্য সিনিয়র নেতারা ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও জি এম কাদের তা ভালোভাবে নেননি। তিনি পরে কাউন্সিল নিয়ে গড়িমসি করতে থাকেন বলে অভিযোগ অনেক নেতার।
জাপা থেকে জি এম কাদের মাইনাস!
কিন্তু দলের সিনিয়র নেতারা ২৮ জুন কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে অটুট থাকেন। বিষয়টি দ্রুতই অনেক দূর এগিয়ে যায়। ডাক উঠে জাপা থেকে জি এম কাদেরকে মাইনাসের।
সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে দেশের অধিকাংশ জেলার শীর্ষ নেতারা জি এম কাদেরবিহীন জাতীয় পার্টি গঠনে সম্মতি দিয়েছেন। বিশেষ করে পার্টির ঘাঁটি বলে পরিচিত রংপুরেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এ জেলার অনেক সিনিয়র নেতাকর্মী নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছেন আনিস-হাওলাদারের সাথে।
জি এম কাদের মাইনাসের উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, ‘জি এম কাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন। অথচ দলের গঠনতন্ত্রে ২০/ক ধারা সৃষ্টি করে তিনি যেকোনো সময় যে কাউকে বহিষ্কার বা পদন্নোতি দিতে পারেন। এমনটা কাম্য হতে পারে না। এ জন্য তাকে কোনো জবাবদিহিও করতে হয় না। আমি এই ধারার বিপক্ষে সব সময়ই বলে আসছি। আজকেও চেয়ারম্যানকে (জি এম কাদের) বলেছি।’
জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফা আল মাহমুদও জাপার চেয়ারম্যানের একনায়কত্বের সমালোচনা করেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘জি এম কাদের নিজেই দলের ভিতর একটি বিতর্কিত ধারা সৃষ্টি করেছেন। যখন-তখন বহিষ্কার করছেন। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম সভার বক্তব্য নিয়ে নানা জায়গায় কথা বলেন যা নৈতিকতাবিরোধী।
দলটি গণতন্ত্রমুখী হোক, প্রেসিডিয়াম সভায় যে সিদ্ধান্ত হবে সেটিই বাস্তবায়ন করতে হবে, কোনোভাবেই একক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না- এমনটাই চান মোস্তফা আল মাহমুদ।
জাতীয় পার্টির জন্মলগ্ন থেকে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে ছিলেন এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। জাপায় জি এম কাদের মাইনাস প্রসঙ্গে দলের এই কো-চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাকে আমরা অনুরোধ করেছিলাম সবাইকে নিয়ে দলটাকে ঐক্যবদ্ধ করতে। সিনিয়র নেতার সাথে আলোচনা করে তিনি বক্তব্য বা সিদ্ধান্ত নিলে দল সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু জি এম কাদের আমাদের কথা তো শুনলেনই না উল্টো বললেন, দল সবার মতামতে চলবে না। আমার একক সিদ্ধান্তেই দল চলবে।’
দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বক্তব্য মূল্যায়িত হতে হবে জানিয়ে জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি যৌথ নেতৃত্বে বিশ্বাস করি। দলকে জনগণের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বক্তব্য মূল্যায়িত হতে হবে।’
অবশ্য কেন্দ্রীয় অনেক নেতার এমন অবস্থানে জি এম কাদের একেবারে একলা হয়ে গেছেন, তেমন না। তাকে ‘মাইনাস’ করার উদ্যোক্তারা পতিত আওয়ামী লীগের দালাল বলে মন্তব্য করেন জাপার আরেক কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
দল ভেঙে গেলেও জি এম কাদের যে অংশে থাকবেন সেটি আসল জাতীয় পার্টি বলে দাবি করে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘এখন যারা জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের দালালি করেছেন।’
নব্বইয়ের গণআন্দোলন এরশাদের পতন হলে প্রথম হুদা-মতিনের নেতৃত্বে জাপা প্রথমবারের মতো ভাগ হয়। ওই দশকেই ১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফা, ১৯৯৮ সালে কাজী জাফর ও শাহ্ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে তৃতীয় দফা ভাঙে দলটি।
এরপর একবিংশ শতকের শুরতেই ২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে চতুর্থ দফা এবং ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে পঞ্চম দফা ভাঙন ঘটে।
সর্বশেষ দলের প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান পদ নিয়ে দ্বন্দ্বে ২০২৪ সালের ৯ মার্চ ষষ্ঠবারের মতো ভাঙে এরশাদের জাতীয় পার্টি। এরশাদের অছিয়ত মতো তার ছোট ভাই জি এম কাদের চেয়ারম্যান হলে বেঁকে বসেন স্ত্রী রওশন এরশাদ। নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করে দলের কমিটি গঠন করেন, যার মহাসচিব করা হয় কাজী মামুনুর রশীদকে।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মারা যান দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা নেন তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ। এরপর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা নয় বছর দেশ শাসন করেন তিনি।
No comments