প্রিয় আম্মা,
প্রিয় আম্মা,
পৃথিবীর সকল কাজেরই কোনো না কোনো একটি উদ্দেশ্য থাকে।উদ্দেশ্যহীন কাজ এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার।গল্প-উপন্যাস-নাটকেই উদ্দেশ্যহীন কাজকে জীবনের অলংকার হিসেবে মানায়।জীবনের নির্মম বাস্তবতা এই যে,আমরা উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কাজই সম্পাদন করিনা।এইযে আজকের এই ‘খোলা চিঠি’র কথাই ধরা যাক।এই ‘খোলা চিঠি’ লেখারও বিশেষ একটি কারণ আছে।মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের কে একই মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন।কিন্তু আমাদের রুহ আলাদা।পৃথিবীতে যতো আশরাফুল মাখলুকাত আছে,সবারই দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা।শতভাগ একই রকমের দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে নেই।তাই রঙ্গিলা এই পৃথিবীতে হরেক রঙের মানুষ বসবাস করে।কেউ গান গাইতে ভালোবাসে,কেউ কবিতা লিখতে ভালোবাসে,কেউ গল্প করতে ভালোবাসে,কেউ ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসে।কেউ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসে,কেউ ভালোবাসে নিজেকে তুলে ধরতে।আমি প্রথম দলের লোক।তাই অনেক কথা বলতে চেয়েও অনেক সময় বলে উঠতে পারিনা।আজ সেসব কথাই বলে দেবো তোমায় আম্মা,জানিনা ঠিক কতটুকু গুছিয়ে বলতে পারবো।
১৯৮৭ সালের আজকের এই দিনে আমাদের পরিবারে তোমার আগমন হয়েছিলো আম্মা।তারই দু'বছর পর বড় আপুর জন্ম।খুব সম্ভবত,তারপর থেকেই তোমার বিপ্লবী জীবনের শুরু।তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে,কেনো তোমার জীবনের একটা বড় অংশকে বিপ্লবী বলে আখ্যা দিয়েছি।যেহেতু "বিপ্লবী" নামক খুব ভারী ওজনের একটি শব্দ আমি এখানে ব্যবহার করেছি,সেহেতু আমি এর ব্যবহার করার কারণটি ব্যাখ্যা করতে বাধ্য।আব্বা তার গ্রাম ছেড়ে কিছুতেই যখন ঢাকায় এসে বসবাস করতে রাজি হচ্ছিলেন না,তখন তুমিই জোর খাটিয়ে ঢাকায় বসবাস করার জন্যে আব্বাকে একপ্রকার বাধ্য করেছো।কারণ তুমি জানতে,গ্রামের পরিবেশে পড়াশোনা করা তখনকার সময়ে সম্ভব ছিলো না।যদি তুমি সেসময় আব্বার কথা শুনে গ্রামেই থেকে যেতে,তাহলে হয়তোবা আমরা পড়াশোনায় এতদুর আসতে পারতাম না।শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে,অচেনা-অজানা এই অদ্ভুত শহরে পার করে দিলে জীবনের প্রায় সব বসন্ত।তারপর সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো।একে একে ছোটো আপু,ভাইয়া,আমার জন্ম হলো।খুব সুখে-শান্তিতেই দিন কাটছিলো।আব্বাও অনেকটা বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন এখানে।কিন্তু,মানুষের জীবন ভরে ওঠে আবার শূন্য হওয়ার জন্যে।এ যেনো জীবনের এক নির্মম নিয়ম।এই নিয়মেরই অংশ হিসেবে,জীবনের সবচে নির্মম রূপ হাজির হয় আমাদের পরিবারে।২০১২ সালে আব্বা ইহকালের সব মায়া ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমান।আমাদের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো।চারদিকে শুধু একটা বাক্যই ধ্বনিত হতে থাকলো—
“এই পরিবারের এখন কি হবে?”
আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের কেউই ঢাকায় থাকতেন না।সবাই বলতে লাগলো,“এই পরিবারের বুঝি এখন গ্রামে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকলো না!”কিন্তু না।তুমি তা হতে দিলেনা।তুমি গো ধরে থাকলে,তুমি ঢাকাতেই থাকবে।ছেলেমেয়েকে মানুষের মতোন মানুষ করবে।তুমি চাইলেই একটা আরামদায়ক জীবন বেছে নিতে পারতে আম্মা।তুমি চাইলেই নিজের জীবনের বাদবাকি বসন্তগুলো রঙিন করে সাজাতে পারতে।কিন্তু না।নিজের জীবনের বাদবাকি বসন্তগুলোকে তুমি আমাদের জন্য মাটিতে জ্যান্ত পুতে ফেললে।নিজের সব সুখ বিসর্জন দিলে।আমাদের পরিবারের সঞ্চিত অর্থে আমাদের পড়াশোনা সহ যাবতীয় সকল ভরণপোষণ চলতে লাগলো।অনেক মানুষ সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এসেছিলেনও বটে,তবে তুমি তাদের মানা করে দিয়েছিলে।কারণ তুমি আমাদের আত্মমর্যাদাবান করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলে।অন্যের সাহায্য-সহযোগিতায় বড় হলে হয়তোবা আজ বুক উঁচিয়ে কোনো কথা বলা দায় হয়ে দাঁড়াতো আমাদের জন্যে।কোনোদিন স্বেচ্ছায় নিজের জন্য একটা সুতা পর্যন্ত কিনতে চাওনি।অতঃপর আমরা বড় হতে লাগলাম।বড় আপুর বিয়ে হলো,ব্যাংকে চাকরি হলো,বাচ্চা হলো।ছোটো আপুর মাস্টার্স শেষ হলো।ভাইয়া অনার্সের পর প্রবাসে গেলো।আর,ক্লাস থ্রিতে বাবা হারানো সেই ছোট্টো ছেলেটি অনার্সে উঠে গেলো।আম্মা আমি জানি,আমি এ পরিবারের সবচাইতে অকর্মন্য।কিন্তু,আমি তোমার বাকিটা জীবনের সবকয়টা বসন্ত রঙিন করে দিতে চাই।আব্বা তো ইহকালের পাট আগেই চুকিয়েছেন।আল্লাহ উনাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুক।তোমার এই বিপ্লবী জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষণ যে কতো কঠিন ছিলো তা কেবল তুমি জানো,আর আল্লাহ তায়ালা জানেন।বিপ্লব তো কোনো গোলাপের তৈরি আরামদায়ক বিছানা নয় আম্মা।বিপ্লব অর্জন করতে হয়।বিপ্লব মানে চলমান কোনো অসুস্থ্য রীতির আমূল পরিবর্তন।তুমি খুব ভালোভাবেই সে পরিবর্তন ঘটিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছো,কীভাবে বিপ্লব করতে হয়।তাই তুমি আমার চোখে মহান বিপ্লবী আম্মা।মহান কমরেড।খুব করে তোমার পা ছুঁয়ে সালাম করতে ইচ্ছে করে।কিন্তু পারিনা।আজীবন তো আমাদের কথা ভেবে গেলে।এবার নাহয় একটু নিজের কথা ভাবো।সবসময় তোমার মঙ্গল কামনা করি আম্মা।
ইতি,
তোমার ছোটো ছেলে
লেখায়: সায়হাম রহমান
follow our Twitter account Dhaka Voice
.webp)

No comments