চট্টগ্রামে ‘বড় ভাইদের’ প্রশ্রয়ে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং
চট্টগ্রাম নগরীতে নতুন নতুন নামে কিশোর গ্যাং গ্রুপ বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টির পাশাপাশি চালাচ্ছে তাণ্ডব। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দখলবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে তারা। কোনো এলাকায় নতুন ভবন তৈরির কাজ শুরু হলে ভবন মালিক কিংবা ঠিকাদারের কাছে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। গ্রুপিং-দ্বন্দ্বে তাদের মধ্যে খুনখারাবির ঘটনাও ঘটছে।
অভিযোগ রয়েছে, ‘বড় ভাইদের’ প্রশ্রয়ে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে নতুন করে ভিন্ন নামে বিভিন্ন গ্রুপে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, গ্রুপ ঠিক থাকলেও নাম ও নেতৃত্বের বদল হয়েছে। এক সময়কার নেতৃত্বদানকারীরা এখন লাপাত্তা। ফলে অন্য বড় ভাইয়েরা হাল ধরেছে। দলে যুক্ত হয়েছে নতুন মুখ। যারা মাদক সেবনের টাকা জোগাতে এ পথে আসে। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কিশোর গ্যাংয়ের অনেক সদস্য গ্রেপ্তার হলেও অধরা থেকে যান ‘বড় ভাইয়েরা’। তারা বরং দলের সদস্যদের ছাড়াতে থানায় গিয়ে তদবির করেন, আদালতে আইনজীবী নিয়োগ করে জামিনের ব্যবস্থা করেন।
চট্টগ্রাম নগরীতে বিঙ্গো গ্রুপ, মাঞ্জিরো টপ, কমার্ড, আয়রন, বিজিবি হল, পেটন, এক্স৯৯৯, এক্সওয়াইজেড, #ট্যাগ, ফুরিউ, এমএস, ডেঞ্জার, ওয়ারিয়র, স্টিল, ক্রিস্টাল, পাইথন. ‘এমবিবিএস’ (মোহাম্মদপুর বয়েস সিন্ডিকেট), এনএস, কেবি, এমবিএক্স, এক্স-মার্ক, ডট গ্যাং ও ব্ল্যাকহোল গ্যাং ইত্যাদি গ্রুপ নামে কিশোর গ্যাং দলের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গণঅভ্যুত্থানের পর চট্টগ্রামে দাপট ছিল না কিশোর গ্যাং সদস্যদের। এর আগে জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে দলীয় মিছিলে ছিল তাদের অংশগ্রহণ। সদস্য পদ না থাকলেও বড় ভাইদের মদদে হাতে লাঠি, কণ্ঠে দলীয় স্লোগান হাঁকিয়ে রাজপথ কাঁপিয়েছে। যদিও রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল থেকে শুরু করে অস্তিত্ব জানান, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, চুরি-ছিনতাই ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে বড় ভাইদের হাতিয়ার ছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, চট্টগ্রামের স্কুলগুলোয় অনুপস্থিত থাকা ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই জড়িয়ে পড়েছে অপরাধে। বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে কেউ শিক্ষার্থী, কেউ দোকানের কর্মচারী। নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সামাজিক অস্থিরতা ও কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানের কারণ খুঁজতে গিয়ে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পায় পুলিশ। এসব ছাত্র পর্নোগ্রাফি, সাইবার অপরাধ, ছিনতাই, চুরি, মাদক নেওয়া ও কেনাবেচা এবং অনলাইন জুয়ার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় স্কুলের সময়টা।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মো. সাদিক হোসেন কালবেলাকে বলেন, কয়েক বছর ধরে হামজারবাগ এলাকায় ভাড়া বাসায় আছি। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়াশোনা করে। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় সবসময় টেনশনে থাকতে হয়।
গত আগস্ট মাসে নগরীর হামজারবাগ এলাকায় এক তুচ্ছ ঘটনায় এক ব্যক্তিকে মারধর করা হয়। এ নিয়ে থানায় মামলা হলে উঠে আসে ‘এমবিবিএস’ গ্যাংয়ের নাম। এ গ্রুপের সদস্যদের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে।
গত ৪ অক্টোবর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে মহড়া দেওয়ার ঘটনায় মুরাদপুর থেকে এনএস কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান ব্ল্যাক মঈনসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত বছরের মার্চে নগর পুলিশের করা এক জরিপে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরে প্রায় ২০০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে, যাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৪০০। জরিপে বলা হয়, গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত ছিল এবং তাদের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে ৬৪ জন ‘বড় ভাই’ রয়েছেন। তাদের নাম পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি।
গত ১৬ মে হালিশহরের নয়াবাজার এলাকায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে ‘পাইথন’ নামের একটি কিশোর গ্যাংয়ের ২২ জন সদস্য তাকে পিটিয়ে আহত করেন। ওয়াহিদুলের পেটে ছুরিকাঘাত করেন কিশোর গ্যাংটির নেতা হিসেবে পরিচিত মো. আতাউল (২২)। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওয়াহিদুলের মৃত্যু হয়।
৪ সেপ্টেম্বর নগরীর হামজারবাগ ও মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে এমবিএসের (মোহাম্মদপুর বয়েস সিন্ডিকেট) ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সবার বয়স ১৬ থেকে ১৭-এর মধ্যে। কেউ শিক্ষার্থী আবার কেউ দোকানের কর্মচারী। পুলিশের দাবি, তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর ‘ডট গ্যাং’ নামের একটি কিশোর গ্যাংয়ের দলনেতা আবদুল্লাহ আল মাসুম (১৯) বড় অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করতে চিকিৎসক বাবার ‘ও’ লেভেল পড়ুয়া ওই শিক্ষার্থীকে অপহরণের পরিকল্পনা করেন। মাসুম নগরের একটি সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়েন। অপহরণের জন্য তিনি এনএস (নাজিরপাড়া সিন্ডিকেট) নামের আরেকটি কিশোর গ্যাংকে ব্যবহার করেন।
গত বছরের ৫ এপ্রিল নগরীর আকবর শাহ থানার ফিরোজশাহ কলোনির কাছে কিশোর গ্যাংয়ের কবলে পড়েছিলেন দন্তচিকিৎসক কোরবান আলীর ছেলে আলী রেজা। ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও হামলার শিকার হন। তার মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করা হলে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। সেখানেই ১০ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার আমিনুর রশিদ কালবেলাকে বলেন, নগরীতে কিশোর গ্যাং থানাভিত্তিক। এ গ্রুপের তালিকা সিএমপির প্রতিটি থানায় অফিসারদের কাছে আছে। কিশোর গ্যাং গ্রুপের অপরাধ দমন ও গ্রেপ্তারে পুলিশ মাঠে কাজ করছে। তাছাড়া থানা পার্টির অভিযানে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন।
নির্বাচন ঘিরে কোনো দলের ব্যানারে কাজ করতে সক্রিয় হতে পারে কি না—এমন প্রশ্ন জবাবে আমিনুর রশিদ বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। আপনারা তো জানেন, মিছিল-মিটিংয়ে রাজনৈতিক নেতারা শিশু কিশোরদের ব্যবহার করে থাকে। তার অর্থ এই নয় যে, তারা দলীয়ভাবে ব্যবহার হচ্ছে। যেহেতু জাতীয় নির্বাচন সর্বসাধারণের নির্বাচন। এ নির্বাচনের মিছিল-মিটিংয়ে অনেকে আনন্দে অংশ নিয়ে থাকে। তবে অপরাধ করলে সেটি আলাদা বিষয়। আর অপরাধ দমন করতেই পুলিশ মাঠে রয়েছে।
আরও পড়ুন বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত ১১ নারী যেসব আসনে লড়বেন
ঢাকাভয়েস/এই


No comments