সুদানের রক্তক্ষয়ী সংঘাতে কোন কোন দেশের স্বার্থ ও প্রভাব কতটুকু ?
গত সপ্তাহে সুদানের দারফুরের এল ফাশার শহর দখল করার পর বিদ্রোহী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) শত শত সুদানি নাগরিককে হত্যার ভয়াবহ ঘটনার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এআড়াই বছর ধরে চলা এই নির্মম সংঘাত ইতিমধ্যেই দেড় লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
সুদানের যুদ্ধ সাধারণত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত হিসেবে উপস্থাপিত হলেও, এতে বিভিন্ন বিদেশি শক্তির জটিল অংশগ্রহণের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল ও প্রাণঘাতী হয়েছে।
অনেকের কাছেই সুদান বৃহত্তর অঞ্চলের কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সেতুবন্ধন হিসেবে পরিচিত সুদান রেড সি উপকূলে প্রায় ৫০০ মাইল এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাখে, যা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ।
দেশটির রয়েছে প্রচুর কৃষি জমি এবং উল্লেখযোগ্য স্বর্ণের খনি। এছাড়া, গাম আরাবিকের প্রধান উৎপাদক হিসেবে খাদ্য, ফার্মাসিউটিক্যাল ও প্রসাধনী শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সুদান। ৪০০ মাইলের নীল নদ তার ভূখণ্ড দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পানি কূটনীতিতেও সুদানের প্রভাব অনস্বীকার্য।
অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন কূটনীতিক চার্লস রে'র মতে, 'যে ব্যক্তি সুদানকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সে বৃহত্তর অঞ্চল, হর্ন অফ আফ্রিকা এবং সাব-সাহারান আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।'
দারফুরে হত্যাযজ্ঞের খবর প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আরএসএফ জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও সৌদি আরব—এই চার দেশের (কোয়াড) প্রস্তাবিত মানবিক যুদ্ধবিরতিতে যোগ দিতে সম্মত হয়েছে।
মিশর ও সুদানের সশস্ত্র বাহিনী ২০২১ সালে সুদানের দক্ষিণ কারদাভান প্রদেশে যৌথ সামরিক মহড়া সম্পন্ন করছে
তবে এই যুদ্ধবিরতি মধ্যস্থতাকারী দেশগুলো—সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মিশর এবং রাশিয়া, সুদানের সংঘাতে বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে অভিযুক্ত। বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংস্থা ও কয়েকটি পশ্চিমা সরকার তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহ, আর্থিক ও লজিস্টিক সহায়তা এবং কূটনৈতিক সমর্থনের অভিযোগ তুলেছে।
২০১৯ সালে দীর্ঘদিনের শাসক ওমর আল-বশিরকে উৎখাত এবং ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের সময় এই দেশগুলোই প্রথমে সুদানের সেনাবাহিনীর সমর্থন করেছিল।
কিন্তু অভ্যুত্থানের দুই প্রধান নেতা; আরএসএফ প্রধান মোহামেদ হামদান দাগালো ওরফে হেমেতি এবং সুদানি সশস্ত্র বাহিনীর (এসএএফ) প্রধান আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান যখন একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হন, তখন বিদেশি শক্তিদের নতুন করে কার পাশে দাঁড়াতে হবে তা নির্ধারণ করতে হয় এবং তাদের অংশগ্রহণ আরও জটিল হয়ে ওঠে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
ইউএইকে বারবার আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বাইডেন প্রশাসনও আরএসএফ বিদ্রোহীদের সঙ্গে কিছু গালফভিত্তিক কোম্পানির সম্পর্কের প্রমাণ পেয়েছে। ইউএই অবশ্য এসব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে।
তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক বিশেষজ্ঞ প্যানেল গত বছর এই অভিযোগগুলোকে 'বিশ্বাসযোগ্য' বলে মন্তব্য করে। মার্কিন সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটি আরএসএফকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি 'বিদেশি পৃষ্ঠপোষক'দের, যার মধ্যে ইউএইও রয়েছে, সংঘাত উসকে দেওয়ার অভিযোগ করেছে।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খালিল আল-আনানি বলেন, ইউএই সুদানে মূলত অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে—কৃষি ও স্বর্ণসহ প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি, তারা সুদানে একটি সফল গণতান্ত্রিক পরিবর্তন দেখতে চায় না।
ইউএইর শীর্ষ কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনওয়ার গারগাশ আরএসএফের সঙ্গে ইউএইর সম্পর্কের প্রতিবেদনগুলোকে 'ভুয়া সংবাদ' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
মিশর
প্রতিবেশী মিশর আল-বুরহান ও এসএএফকে সুদানের বৈধ ক্ষমতা হিসেবে দেখে। তারা আল-বুরহানের মন্ত্রিসভার সঙ্গে বারবার বৈঠক করেছে, কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে। হেমেতি অতীতে মিশরকে এসএএফকে অস্ত্র সরবরাহ এবং আরএসএফের ওপর হামলার অভিযোগ করেছেন, যা মিশর অস্বীকার করেছে।
২০২৪ সালে লন্ডনের মার্কিন দূতাবাস থেকে সংসদ ভবনের দিকে মিছিল করেন বিক্ষোভকারীরা
সুদানের অস্থিতিশীলতার নীল নদে প্রভাবকে কেন্দ্র করে মিশরের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ রয়েছে। আল-আনানি মনে করেন, কায়রোর আরেকটি মূল উদ্দেশ্য হলো 'আল-বশিরের পতনের পর সুদানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা আটকানো।' তবে মিশরের সমর্থন সীমিত, কারণ তারা ইউএইর ওপর ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল।
সৌদি আরব
আনুষ্ঠানিকভাবে রিয়াদ নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথা বললেও, পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে সৌদি আরব আল-বুরহান ও তার এসএএফকে সূক্ষ্মভাবে সমর্থন করেছে এবং কূটনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছে। রেড সি বরাবর স্থিতিশীলতা বজায় রাখা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সৌদি আরবের সুদানে গভীর অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো নিশ্চিত করা যে দেশটি তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বারা প্রভাবিত না হয়।
রাশিয়া
ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও রাশিয়া সুদানকে আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, রাশিয়া 'সংঘাতের দুই পক্ষকেই ব্যবহার করছে নিজের স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য।'
সিএনএন পূর্বে জানিয়েছিল যে রাশিয়ান ভাড়াটে গ্রুপ ওয়াগনার আরএসএফকে সিরিয়া, লিবিয়া ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছিল। ওয়াগনার সুদানের স্বর্ণখনির বড় পরিমাণ জমিতেও জড়িত ছিল। ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের মৃত্যুর পর ক্রেমলিন এখন ওয়াগনার ও তার যোদ্ধাদের রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে।
যদিও ওয়াগনার হেমেতিকে সমর্থন করেছে, ক্রেমলিন আল-বুরহানের সঙ্গে রেড সি-তে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণের বিষয়ে চুক্তি করার চেষ্টা করছে।
স্বাধীন গবেষক সেলমা এল ওবেইদ বলেন, সুদানের সংঘাতে 'কোনো নিরপেক্ষ পক্ষ নেই।' তার মতে, 'প্রত্যেক পক্ষের নিজস্ব লক্ষ্য রয়েছে এবং তারা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য হস্তক্ষেপ করছে।'
দীর্ঘদিনের নৃশংস সহিংসতা সুদানকে দুর্বল করেছে, তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশৃঙ্খল করে তুলেছে এবং জনগণকে আরও অসহায় ও দরিদ্র করেছে। এই পরিস্থিতি দেশটির জন্য বিদেশি শক্তির শোষণের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
ঢাকা ভয়েস /এসএস


No comments