আত্মশুদ্ধির অন্তরায় তিন অভ্যাস
আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, প্রযুক্তির ছোঁয়া আর বিলাসিতার ঘূর্ণিপাকে আমরা যেন দিন দিন আত্মিক দিক থেকে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। শরীরের খাওয়া-পরা, ঘুম আর আরাম-আয়েশে যতটা মনোযোগ, আত্মার পরিচর্যায় ততটাই অবহেলা। অথচ ইসলামি জীবনবোধ আমাদের শিখিয়েছে আত্মার শক্তিকেই রাখতে হবে কেন্দ্রস্থলে। আর এ পথের প্রথম ধাপ হলো আত্মিক শক্তিকে নিঃশেষকারী তিনটি অভ্যাস থেকে দূরে থাকা। তা হলো অতিরিক্ত খাওয়া, অতিরিক্ত ঘুম ও প্রবৃত্তির দাসত্ব।
এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো
অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া : আধুনিক বিশ্বে স্বাস্থ্য সচেতনতায় ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’, ‘১৬ ঘণ্টার ডায়েট’, ‘মেডিটেরিয়ান ফুড’ ইত্যাদির কথা সবাই জানে। কিন্তু এ নিয়মিত নিয়ন্ত্রণের মর্মবাণী ইসলাম আমাদের দিয়েছে আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) শুধু রমজানের রোজা নয়, সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার, আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখেও রোজা রাখার উৎসাহ দিয়েছেন। এর পেছনে রয়েছে এক অনন্য হিকমত। তা হলো প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরা।
এই যুগ ভোগের যুগ। চারপাশে খাবারের ছড়াছড়ি, বাজার ভর্তি লোভনীয় দ্রব্য, ডিজিটাল স্ক্রিনে একের পর এক খাবারের প্রলোভন। আমরা যে খাচ্ছি, তা শুধু ক্ষুধার কারণে নয়, বরং অভ্যাস, অস্থিরতা ও আত্মার প্রবৃত্তি পূরণ করতে গিয়ে। রোজা আমাদের সেই নিরবচ্ছিন্ন চাহিদার শেকড় কেটে দেয়। নবীজির শিক্ষা হলো, ‘তোমার খাবারের চাহিদা যেন তোমাকে চালিত না করে, বরং তুমি তাকে চালাও।’
অতিরিক্ত ঘুম : তাজকিয়া অর্থ আত্মার শুদ্ধিকরণ। ইবাদতের প্রাণ হলো এই তাজকিয়া। তাজকিয়া না থাকলে নামাজ কেবল এক শারীরিক অনুশীলনে পরিণত হয়। কিন্তু আত্মা বিশুদ্ধ থাকলে সেই নামাজ হয়ে ওঠে আল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংলাপ। ইসলামের মহাপুরুষরা বেশি ঘুমাতেন না। তারা ঘুম কমিয়ে সময় ব্যয় করতেন কিয়ামুল লাইল (রাতের দীর্ঘ নামাজ), তেলাওয়াত ও মোনাজাতে। তা তাদের জন্য কষ্টের ছিল না, ছিল আনন্দের। তাদের হৃদয় ছিল আল্লাহর প্রেমে পরিপূর্ণ।
প্রবৃত্তির দাসত্ব : মানবহৃদয়ে রয়েছে দুটি শক্তি, ভালো ও মন্দ। যেটির অনুসরণ করবে, সেটিই প্রভাবশালী হবে। যদি শরীর আর প্রবৃত্তিকে সুযোগ দেওয়া হয়, তবে আত্মা ক্ষীণ হয়ে যায়। আর যদি আত্মাকে জাগ্রত করা হয় তাজকিয়া, জিকির ও দোয়ার মাধ্যমে, তবে মন্দ প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে যায়।
আজকের সমাজ উৎসবনির্ভর। যেকোনো আয়োজন মানেই খাবার, চমক ও চাটুকারিতা। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো সহজতা। আর স্বাচ্ছন্দ্যের সময়েই আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলো কাম্য। কষ্ট আসলে আমরা আল্লাহর দিকে ফিরি। কিন্তু প্রকৃত মুমিন সেই, যে স্বাচ্ছন্দ্যের সময়েই তার প্রভুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। হাদিসে এসেছে, স্বাচ্ছন্দ্যের সময়ে আল্লাহকে চিনো, তাহলে কষ্টের সময় তিনি তোমাকে চিনবেন।’
আত্মশুদ্ধিই প্রকৃত সফলতা। আত্মিক উন্নতির জন্য আজ কোনো দামি কোর্সের দরকার নেই। দরকার আন্তরিকতা, ধারাবাহিকতা এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা। যে আল্লাহকে ভালোবাসে, সে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে। ভুল হলে হতাশ না হয়ে ক্ষমা চায়। মহান আল্লাহ আমাদের আত্মশুদ্ধি অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমিন।
No comments