নেতানিয়াহুর সামনে ৬ বিপদ
গাজায় গত দুই বছর ধরে যুদ্ধে ইসরায়েল বহু ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ইসরায়েলের হামলায় বহু ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। সেখানে সৃষ্টি হয়েছে মানবেতর পরিস্থিতি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এখন সেখানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। কিছু বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য এই শান্তি যেন সময়ের আগেই চলে এসেছে।
সমালোচকদের অভিযোগ, নেতানিয়াহু যুদ্ধকে নিজের ক্ষমতা ও এমনকি ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর চলমান চ্যালেঞ্জগুলো থেকে মনোযোগ সরানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, এসব চ্যালেঞ্জের কোনোটিই দূর হয়নি।
এই যুদ্ধবিরতিকে নেতানিয়াহু জয়ের প্রতীক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত অ্যালন পিঙ্কাস মনে করেন, এটি সাজানো এবং ওয়াশিংটনের চাপেই তাকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের যুদ্ধের বাড়তে থাকা আর্থিক ও কূটনৈতিক বোঝা আর সহ্য করতে পারছে না।
যদি নেতানিয়াহু আর কোনো যুদ্ধ করতে না পারেন, তাহলে আগামী নির্বাচনের আগে ও পরে তার সামনে কী জটিলতা অপেক্ষা করছে এবং সেগুলো তার জন্য কতটা বিপজ্জনক হতে, তা উঠে এসেছে আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী কি আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হবেন ?
ইসরায়েলের এমন দশা এর আগে দেখা যায়নি। দেশটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে এমন একা এর আগে কখনোই হয়নি। অনেকের দৃষ্টিতে নেতানিয়াহু এই বিচ্ছিন্নতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
গত দুই বছরে ইসরায়েলের হাতে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু এবং গাজায় সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের দৃশ্য বিশ্বজুড়ে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে।
নেতানিয়াহুর সরকার যদি আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ সীমাবদ্ধ করতে না পারে, তবে সেখানে ঘটে যাওয়া মানবিক বিপর্যয়ের সংবাদ কিছু সময়ের জন্য হলেও ইসরায়েলের বিচ্ছিন্নতাকে আরও দৃঢ় করবে।
ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা কয়েক মাস ধরেই স্পষ্ট। সেপ্টেম্বরে নেতানিয়াহু তার 'সুপার স্পার্টা' পরিকল্পনার রূপরেখা উপস্থাপন করেন। প্রাচীন যুদ্ধপ্রধান গ্রিক রাষ্ট্রের রূপক ব্যবহার করে তিনি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং লাগাতার যুদ্ধে প্রবেশের নকশা প্রণয়ন করেন।
কিন্তু এটি মোটেও সাদরে গ্রহণ করা হয়নি। এতে ইসরায়েলের শেয়ারবাজার সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়ে। শেকেলের মান অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় তলানিতে চলে যায়। দেশটির ২০০টি প্রধান কোম্পানির প্রতিনিধিত্বকারী ইসরায়েল বিজনেস ফোরাম স্পষ্টভাবে বলে দেয়, 'আমরা স্পার্টা নই।'
ডানপন্থিরা কি নেতানিয়াহুর জোট সরকার ভেঙে দিতে পারে ?
ডানপন্থিরা কি জোট সরকার ভেঙে দিতে পারে। তবে নেতানিয়াহু এরইমধ্যে তা ঠেকাতে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
যুদ্ধ চলাকালীন এবং এর আগে ইসরায়েলের বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন নেতানিয়াহু তার সরকার টিকিয়ে রাখতে প্রধানত দেশটির চরম ডানপন্থি দলগুলোর সমর্থনের ওপর নির্ভর করেন। অর্থাৎ, এই দলগুলো তার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভরসা।
সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হলো অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোৎরিচ এবং জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির আপাতত নেতানিয়াহুর জোটের মধ্যেই আছেন। যদিও তারা যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করেন।
কিছু সদস্য না জোট ত্যাগ করে, সেই শঙ্কায় নেতানিয়াহু আলট্রা-অর্থোডক্স ইয়েশিভা শিক্ষার্থীদের সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান থেকে মুক্ত রাখার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছেন।
মনে করা হচ্ছে, এতে আলট্রা-অর্থোডক্স দলগুলো আবারও তার সরকারের সঙ্গে যুক্ত হবে। এতে সরকার ভেঙে যাবে না।
আইসিসি ও আইসিজে কি এখনো নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে ?
হ্যাঁ, করতে পারে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) নেতানিয়াহু, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত এবং হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরে ইসরায়েল দেইফকে হত্যা করে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতও (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ বিবেচনা করছে। মনে করা হচ্ছে, দোষী সাব্যস্ত হলে নেতানিয়াহুকে এর জন্য দায়ী করা হবে।
গ্যালান্ত ও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির মামলার জন্য এখনো কোনো রায়ের সময় ঠিক করা হয়নি। আইসিজের মামলার রায়ও অন্তত ২০২৭ সালের আগে আশা করা যাচ্ছে না।
যদি তারা দোষী সাব্যস্ত হন, আইসিসি সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত জেল দিতে পারে। আর আইসিজে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিলে তা কার্যকর করার জন্য সাধারণত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে পাঠানো হয়।
ট্রাম্প কি নেতানিয়াহুর সঙ্গ ছাড়তে পারেন ?
হ্যাঁ, এটি সম্ভব। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়ক এবং কূটনৈতিক শক্তি। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে নেতানিয়াহুও গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন।
নেতানিয়াহু অবশ্য দাবি করেন, তার প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন স্পষ্ট। ২০২১ সালে নেতানিয়াহু যখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় অভিনন্দন জানান, তখন ট্রাম্প রেগে যান।
মে মাসে ট্রাম্প মনে করেন নেতানিয়াহু তাকে চালানোর চেষ্টা করছেন, তাই তিনি নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
সেপ্টেম্বরে দোহায় হামাস কূটনীতিকদের ওপর ইসরায়েলের হামলার পর নেতানিয়াহুর প্রতি ট্রাম্পের ক্ষোভ চরমে পৌঁছে। তিনি তখন বলেন, 'সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে।'
যুদ্ধবিরতির আগে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর মধ্যে বিরোধ তীব্র হয়েছিল। ট্রাম্প তখন জানিয়েছিলেন, তিনি নেতানিয়াহুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তার অনুমতি ছাড়া তিনি গাজায় সেনা মোতায়েন করতে পারবেন না।
ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি শুরুর সময়ে বলেন, এটি তিন হাজার বছরের প্রস্তুতির ফল এবং এটি টিকে থাকবে। কেউ যদি সেই শান্তিকে ঝুঁকিতে ফেলে বা নষ্ট করার চেষ্টা করে, তিনি সেটা সহজে মেনে নেবেন না বরং শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাবেন।
৭ অক্টোবরের হামলার আগে নেতানিয়াহুর ব্যর্থতা নিয়ে কি ইসরায়েলে তদন্ত হবে ?
এখন এটি ক্রমেই বাস্তব হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় এক হাজার ১৩৯ জন নিহত হন এবং ২৫০ জনকে অপহরণ করে গাজায় নেওয়া হয়।
সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা নিয়ে করা আলাদা তদন্তে দেখা যায়, নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তীব্র অবহেলা ও বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল, কারণ তারা এমন হামলা আশা করেনি। প্রতিটি তদন্তের পরই সেনা ও গোয়েন্দা প্রধানরা পদত্যাগ করেন।
নেতানিয়াহু এসব তদন্তে আপত্তি করেননি। কিন্তু নিজের সরকারের ভূমিকা নিয়ে তদন্তে তিনি বাধা দেন। তিনি বলেন, এটি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হবে এবং যুদ্ধের সময় এটি করা সম্ভব নয়।
তবে যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলের হাইকোর্ট রায় দেয়, এটি বিলম্ব করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই এবং সরকারকে ৩০ দিনের মধ্যে জবাব দিতে হবে।
নেতানিয়াহু কি জেলে যেতে পারেন ?
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা এখনো রয়ে গেছে। ট্রাম্প সোমবার ইসরায়েলি সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সময় ইঙ্গিত দেন যে গাজায় ইসরায়েলের দীর্ঘ যুদ্ধ এবং নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলার মধ্যে সংযোগ আছে।
ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জগের প্রতি আহ্বান জানান, নেতানিয়াহুকে যেন তিনি ক্ষমা করে দেন।
বর্তমানে নেতানিয়াহুর তিনটি দুর্নীতি মামলা চলছে। যুদ্ধ চলাকালীন এসব মামলা অনেকবার বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে আছে ঘুষ নেওয়া, প্রতারণা এবং বিশ্বাসভঙ্গ। দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল হতে পারে।
ঢাকা ভয়েস /এসএস
No comments