বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে অসংগতি, রাজনৈতিক মতামত সমন্বয়ের চিন্তা
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল যেসব পরামর্শ দিয়েছে, তাতে কিছু অসংগতি সামনে এসেছে। কমিশন এখন সেসব বিষয়ে পরামর্শকদের মতামত চেয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে যেসব মতামত পাওয়া গেছে, সেগুলোও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে যথাসম্ভব সমন্বয় করবে কমিশন। শনিবার জাতীয় সংসদে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত কমিশন সূত্র সমকালকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পরামর্শে বলা হয়েছে, সনদে যেসব সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সাংবিধানিক আদেশ জারি করলে তা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে যাবে। সনদে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে– এ প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ ধারা অনুযায়ী সাংবিধানিক আদেশ জারি করা হবে। কিন্তু এখনও ঘোষণাপত্রটির আইনি ভিত্তি তৈরি না হওয়ায় এর অধীনে কীভাবে সংবিধানিক আদেশ জারি করা হবে– এ প্রশ্নও উঠেছে। সনদ বাস্তবায়নে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা যায় কিনা– গতকালের বৈঠকে এ আলোচনাও হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি হিসেবে সাংবিধানিক আদেশ জারি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক আদেশ জারির ক্ষমতা আছে কিনা– এসব প্রশ্নের মীমাংসায় বিএনপি আগের আলোচনায় ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণের প্রস্তাব করেছিল। কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল অবশ্য আগে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণের পরামর্শ থেকে সরে এসেছিল। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে বলেছেন, বিশেষজ্ঞরা সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ, গণভোট, অধ্যাদেশ এবং নির্বাহী আদেশের পরামর্শ দিয়েছেন। অবশ্য পরে তারা সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের পরামর্শ দেন। আর রাজনৈতিক দলগুলো গণভোট, সাংবিধানিক আদেশ, ১০৬ অনুচ্ছেদ, গণপরিষদ, সংবিধান সভা এবং পরবর্তী সংসদসহ ছয়টি বাস্তবায়ন পদ্ধতির কথা বলেছিল আলোচনায়। গতকাল এসব পরামর্শ এবং মতামত সমন্বয় করে প্রস্তাব তৈরির বিষয়ে আলোচনা হয়। জুলাই সনদের সাংবিধানিক সংস্কার অংশ বাস্তবায়নে বিএনপি ১০৬ অনুচ্ছেদকেই উত্তম মনে করছে। গতকাল দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বিচার বিভাগের রায় মানা না হলে রাষ্ট্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। আদালতের রায়ের বাইরে গিয়ে কোনো রাজনৈতিক সমাধান টেকসই হয় না।কমিশনের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, রাজনৈতিক বিষয় আদালতে না টানাই উত্তম। কমিশনের একজন সদস্য সমকালকে বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য ৩০ নভেম্বরের আগে সংস্কারের কার্যক্রম শেষ করতে হবে। তারা মনে করছেন, আদালতে গেলে প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত হতে পারে। আবার আদালতের সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। এই বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞরা আদালতের মতামত গ্রহণকে নিরুৎসাহিত করেছেন। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেছেন, ১০৬ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টের উপদেশমূলক এখতিয়ার। সংবিধানে তো অন্তর্বর্তী সরকার, সাংবিধানিক আদেশ বলে কিছু নেই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ সংস্কারের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। এই অভিপ্রায় বলে সাংবিধানিক আদেশে সংস্কার করে তা গণভোটে দেওয়া যায়। জনগণ গ্রহণ না করলে অন্য কিছু ভাবা যাবে। গত বুধবার সংলাপে কমিশন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কমিশন প্রস্তাব করেছিল–
১. অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারি করতে পারে; যেখানে জুলাই সনদে উল্লিখিত মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে।
২. ওই আদেশে গণভোটের বিধান রাখা যেতে পারে এবং সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট হবে।
৩. যদি গণভোটের মাধ্যমে জনগণ সাংবিধানিক আদেশের প্রতি সম্মতি দেয়, তবে তা কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকেই অনুমোদিত বলে গণ্য হবে।
সংলাপে বিএনপিসহ কয়েকটি দল বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র পঠিত হলেও কার্যকর হয়নি। ফলে ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক আদেশ জারির এখতিয়ার নেই। গতকালের বৈঠকে যোগ দেওয়া একজন বিশেষজ্ঞ সমকালকে বলেছেন, কমিশন বিষয়টি উত্থাপন করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঘোষণাপত্রে সংস্কারের জন্য জনগণের অভিপ্রায়ের কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কমিশন প্রস্তাব করেছে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট হবে। বিএনপি বলেছে, আগামী সংসদে সাংবিধানিক সংস্কার গৃহীত হওয়ার পর গণভোট হবে। জামায়াত চায়, নির্বাচনের আগেই সাংবিধানিক সংস্কার কার্যকর করে গণভোটে দিতে হবে। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, গতকাল গণভোটের সময় নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি কমিশন। কমিশন বিশেষজ্ঞদের জানিয়েছে, কোন সময়ে গণভোট হলে ভালো হয়, তা লিখিতভাবে জানাতে। কমিশন সদস্য বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেছেন, গণভোট, সাংবিধানিক আদেশ, ১০৬ অনুচ্ছেদ, ঘোষণাপত্রের ২২ ধারা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা তাদের বিস্তারিত মতামত জানাবেন। কমিশনের সহসভাপতি আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরবেন। সেদিন আবার বিশেষজ্ঞদের বৈঠক হবে। কমিশনের বর্ধিত মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৫ অক্টোবর। এর আগেই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন। ১১ সেপ্টেম্বর সনদ চূড়ান্ত হয়েছে। এতে থাকা সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তের ১১টিতে বিভিন্ন দলের আপত্তি রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ কয়েকটি সিদ্ধান্ত ক্ষমতায় গেলে বাস্তবায়নে রাজি নয় বিএনপি। সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা সাংবিধানিক বিতর্কের মধ্যে পিআরের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে জামায়াতসহ সাত দল। গতকালের বৈঠকের ঐকমত্য কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও কৌশল নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ ও পরামর্শের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে তা বিবেচনায় আনা হয়।বৈঠকে পরামর্শকদের মধ্যে অংশ নেন আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন, বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক।উপস্থিত ছিলেন কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
আরও পড়ুন দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা
No comments