পরকালের তুলনায় দুনিয়া যেমন
মানুষ দুনিয়াকে বহু মূল্যবান সম্পদ মনে করে। অথচ পরকালের তুলনায় দুনিয়ার সম্পদ ও প্রাচুর্য হলো অতি তুচ্ছ ও মূল্যহীন বস্তুর মতো। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। নিশ্চয়ই আখেরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৬৪)
এ আয়াতে দুনিয়ার জীবনকে ক্রীড়া-কৌতুক বলা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, ক্রীড়া-কৌতুকের যেমন কোনো স্থিতি নেই এবং এর দ্বারা কোনো বড় সমস্যার সমাধান হয় না, অল্পক্ষণ পরেই সব তামাশা খতম হয়ে যায়, দুনিয়ার জীবনের অবস্থাও তদ্রƒপ। দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতা শুধু এতটুকুই যেমন ছোট ছেলেরা কিছুক্ষণের জন্য খেলাধুলার মাধ্যমে আমোদ করে এবং তারপর যার যার ঘরে চলে যায়। জীবনের কোনো একটি আকৃতিও এখানে স্থায়ী ও চিরন্তন নয়। যে যে অবস্থায়ই আছে, সাময়িকভাবে একটি সীমিত সময়কালের জন্যই আছে। যদি তারা এ কথা জানত, এ দুনিয়ার জীবন একটি পরীক্ষার অবকাশ মাত্র এবং মানুষের জন্য আসল জীবন, যা চিরকাল স্থায়ী হবে, তা হচ্ছে আখেরাতের জীবন, তাহলে তারা এখানে পরীক্ষার সময় কালকে খেল-তামাশায় নষ্ট না করে এর প্রতিটি মুহূর্ত এমনসব কাজে ব্যবহার করত, যা সেই চিরন্তন জীবনের জন্য উৎকৃষ্ট ফলদায়ক হতো। দুনিয়ার জীবনের ওপর আখেরাতের জীবনকে প্রাধান্য দিত। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
যে পার্থিব জীবন তাদের পরকালের জীবন সম্বন্ধে অন্ধ এবং তার জন্য সম্বল সঞ্চয় করার ব্যাপারে উদাসীন করে রেখেছে, তা আসলে এক ধরনের খেলাধুলা অপেক্ষা বেশি মর্যাদা রাখে না। কাফেররা পার্থিব জীবন নিয়ে ব্যাপৃত থাকে, তাতে সুখ অর্জনের জন্য দিবারাত্রি মেহনত করে, কিন্তু যখন মারা যায়, তখন শূন্য হাত হয়ে পরকালের পথে পাড়ি দেয়। যেমন শিশুরা সারা দিন ধুলোবালির ঘর বানিয়ে খেলা করে এবং পরে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় খালি হাতে ফিরে যায়, ক্লান্তি ছাড়া তাদের আর কিছুই অর্জন হয় না।
যদি তারা এ কথা উপলব্ধি করতে পারত তাহলে পারলৌকিক জীবন সম্বন্ধে অমনোযোগী হয়ে ইহলৌকিক জীবন নিয়ে মগ্ন হতো না। বলা বাহুল্য, এর ওষুধ হচ্ছে জানা ও শেখা, বিশেষ করে শরিয়তের জ্ঞান শিক্ষা করা।
এক হাদিসে এসেছে, জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একবার রাসুল (সা.) একটি কান কাটা মৃত বকরির বাচ্চার কাছ দিয়ে অতিক্রমকালে সাহাবিদের বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, এটিকে এক দিরহামের বিনিময়ে নিতে পছন্দ করবে? সাহাবিরা বললেন, আমরা তো এটিকে কোনো কিছুর বিনিময়েই নিতে পছন্দ করব না। তখন রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহর কসম! এটি তোমাদের কাছে যতটা তুচ্ছ, আল্লাহতায়ালার কাছে এ দুনিয়া এবং দুনিয়ার সম্পদ এর চেয়েও বেশি তুচ্ছ।’ (সহিহ মুসলিম ২৯৫৭)
সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এ দুনিয়ার মূল্য যদি আল্লাহতায়ালার কাছে মশার একটি পাখার সমানও হতো, তাহলে তিনি কোনো কাফেরকে এক ঢোক পানিও পান করাতেন না।’ (সুনানে তিরমিজি ২৩২০)
মুসতাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া পরকালের তুলনায় এতটুকু, যেমন তোমাদের কেউ তার একটি আঙুল সমুদ্রের পানিতে ডুবিয়ে তুলে নিল। অতঃপর খেয়াল করে দেখা উচিত যে, তার আঙুলে সমুদ্রের কী পরিমাণ পানি লেগে আছে।’ (সহিহ মুসলিম ২৮৫৮)
বস্তুত এ তুলনা ও উপমা শুধু বোঝানোর জন্য। কেননা আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াটা এ পরিমাণও নয়, সমুদ্রের তুলনায় আঙুলে অবশিষ্ট পানিটুকু যে পরিমাণ। কারণ দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছু হলো অস্থায়ী। আখেরাত হলো, চিরস্থায়ী ও অনন্ত-অসীম।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া হলো মুমিনের জন্য কারাগার। আর কাফেরের জন্য জান্নাত।’ (সহিহ মুসলিম ২৯৫৬)। ‘কাফেরের জন্য জান্নাত’ মানে হলো, তার কাক্সিক্ষত ঠিকানা এ দুনিয়াটাই। এ দুনিয়া ছাড়া তার জীবনের আর কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেই।
দুনিয়া ‘মুমিনের জন্য কারাগার’, এর মানে এই নয় যে, দুনিয়ায় মুমিনের কষ্ট অবশ্যই হবে। বরং কারাগার মানে হলো, এই দুনিয়া মুমিনের জন্য একটি অস্থায়ী বাড়ি। কারাগার যেমন অস্থায়ী হয়ে থাকে, তেমন। তাই মুমিন এ দুনিয়ার সঙ্গে অন্তর লাগিয়ে রাখে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সব চেষ্টা-শ্রম মুমিন এ দুনিয়ার জন্য করে না। হাসান বসরি (রহ.) বলতেন, ‘হে দুনিয়া, তুমি কতই না নিকৃষ্ট! তোমার প্রতিটি কাঠিই আমি চুষেছি। দেখলাম সব কটাই শেষপ্রান্তে গিয়ে তেতো।’
আবু হুরায়রা (রা.) হতে অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘দুনিয়া এবং তাতে যা কিছু আছে সবই অভিশপ্ত। কিন্তু আল্লাহর জিকির এবং তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অন্যান্য আমল এবং আলেম ও ইলম অন্বেষণকারী ছাড়া।’ (সুনানে তিরমিজি ২৩২২)
ওবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কেয়ামতের দিন দুনিয়াকে উপস্থিত করা হবে, তখন দুনিয়ার যা কিছু আল্লাহর জন্য ছিল তা পৃথক করা হবে, তারপর অবশিষ্ট দুনিয়াকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসনাদে আহমদ)
আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কারও ব্যাপারে যদি শপথ করে বলতে পারো যে, সে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে দুনিয়াবিমুখ, তাহলে আমিও শপথ করে বলতে পারি, সে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম লোক।’
ইব্রাহিম তাইমি (রহ.) বলেছেন, ‘তোমাদের ও পূর্ববর্তীদের মধ্যে কতই না পার্থক্য! দুনিয়া তাদের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে। কিন্তু তারা দুনিয়া থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। অথচ তোমাদের থেকে দুনিয়া পিছু হটে যায় আর তোমরা এর পেছনে পেছনে ছোটো।’ (হিলইয়াতুল আওলিয়া ৪/২১২)
দুনিয়া স্থায়ী আবাস নয়। এখানে সবকিছু ক্ষণিকের ও ক্ষয়িষ্ণু। সুতরাং প্রকৃত জীবন শুধু আখেরাতেরই জীবন। এজন্য প্রকৃত বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে দুনিয়াতেই পরকালের পাথেয় ও পুঁজি সংগ্রহ করে। শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তিকে স্বীয় আয়ত্তাধীনে রেখেছে এবং মৃত্যুর পরের জন্য (অর্থাৎ পরকালের মুক্তির জন্য) নেকির পুঁজি সংগ্রহ করেছে, সে ব্যক্তিই প্রকৃত বীরপুরুষ ও বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে আল্লাহর প্রতি ক্ষমার আশা পোষণ করে, মূলত সেই মূর্খ ও কাপুরুষ।’ (সুনানে তিরমিজি ২৪৫৯)
সৌভাগ্যবান বান্দা তো তারাই, যারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে পরকালের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করে। পিঁপড়া যেমন শীতকালের দুর্ভোগ থেকে বাঁচার জন্য গ্রীষ্মকালেই খাবার ও পাথেয় সংগ্রহ করে রাখে। মুমিন বান্দাও ঠিক তেমনি পরকালের কঠিন দুর্ভোগ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে দুনিয়াতে থাকতেই আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের মাধ্যমে নেক আমল সংগ্রহ করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বস্তুত তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী।’ (সুরা আলা ১৬-১৭) তাই দুনিয়ার নির্ধারিত ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহে পড়ে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ থেকে উদাসীন হওয়া যাবে না।
No comments