Adsterra

লোড হচ্ছে...

অপবাদ দেওয়ার পরিণতি ভয়াবহ

অপবাদ দেওয়ার পরিণতি ভয়াবহ,ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Trending News, Viral News, Top News, Hot News, bangla news, bangladesh,

জীবনের পথচলায় মানুষ ভুল করে। এটা খুবই স্বাভাবিক। ইসলাম মানুষকে সেই ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ দেয়। সংশোধনের দরজা খোলা রাখে। একজন পাপীও তওবার মাধ্যমে হয়ে যেতে পারে আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তবে কিছু ভুল ও অন্যায় আছে, যা একবার কেউ করলে শুধু নিজের নয়, অন্যের জীবনকেও এলোমেলো করে দেয়। এমনই এক ভয়াবহ অন্যায় হলো অপবাদ দেওয়া। এর শাস্তি খুবই ভয়াবহ।

অপবাদ আগুনের মতো। অপবাদের আঘাত ভেঙে দেয় মানুষ, পরিবার, সমাজসহ সবকিছুকে। কারও নামে একটা মিথ্যা কথা, একটা মিথ্যা ইঙ্গিত অথবা সামান্য সন্দেহ ছড়িয়ে দিলে সে মানুষ আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস পায় না। তার মান-সম্মান, আত্মমর্যাদা সবকিছু মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে।

কথার আঘাত চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এর ব্যথা অনেক গভীর, অনেক দীর্ঘস্থায়ী। কখনো কখনো এই ব্যথা এমন এক ক্ষত তৈরি করে, যে ব্যথা কখনই শেষ হয় না। এমন অনেকেই আছে, যারা কেবল অপবাদের বোঝা সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এমন অনেক পরিবার আছে, যা একটিমাত্র গুজবের কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। অথচ হয়তো সেই অপবাদ ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

ইসলাম এই ভয়ানক সামাজিক ব্যাধিকে শুধু ঘৃণা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং কোরআন ও হাদিসে এ ব্যপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে। সুরা নুর-এ যদি চোখ রাখি, দেখা যাবে অপবাদদাতাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে লাঞ্ছনার ঘোষণা এবং এই দুনিয়াতেও শারীরিক শাস্তির বিধান। কারণ অপবাদ শুধু একজন ব্যক্তিকে আঘাত করে না, এটি একটি পরিবারকে কলঙ্কিত করে, একটি সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে, এমনকি একটি জাতির ভিত পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।

আজকের সমাজে অপবাদ ও মিথ্যা যেন নিত্যনৈমিত্তিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ এখন সহজেই কারও নামে মিথ্যা রটিয়ে দেয়। অপরের চরিত্রে কালিমা লেপন করে। এই নিন্দনীয় কাজটা করতে গিয়ে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে চায়ের দোকান, গলির মোড়সহ সর্বত্রই সত্য যাচাই না করে অপবাদ ছড়ানোর এই ব্যাধি আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

ব্যক্তিজীবনে কেউ একটু গুছিয়ে চললেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। পরিবারে কেউ সত্য কথা বললে কিংবা অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাকে বিদ্রোহী তকমা দেওয়া হয়। সামাজিকভাবে কেউ ন্যায়নীতির পক্ষে দাঁড়ালে তার অতীত খুঁড়ে চরিত্র হননের চেষ্টা শুরু হয়। কেউ ধর্মীয়ভাবে অগ্রসর হলে তাকে ভণ্ড বলা হয়। আবার কেউ নেতৃত্বে উঠতে চাইলে, সমাজে ন্যায়ের পথে কাজ করতে চাইলে তার নামে রটানো হয় অপবাদ, ছড়ানো হয় গুজব, বানানো হয় মনগড়া গল্প।

আর সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই অপবাদ ছড়ানোর পেছনে থাকে হিংসা, প্রতিহিংসা, আত্মমর্যাদার লড়াই কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। অথচ একজন মুসলিমের উচিত ছিল সত্য যাচাই করা, ভাইয়ের প্রতি সদয় থাকা, সম্মান রক্ষা করা। কিন্তু আমরা হয়ে গেছি উল্টো পথে চলমান এক সমাজের মতো, যেখানে মিথ্যার বাজার গরম, আর সত্যের কণ্ঠ রুদ্ধ। এই সমাজে সত্যিকারের মানুষের জন্য জায়গা সংকুচিত হয়ে গেছে, আর মিথ্যাবাদী ও অপবাদদাতারাই যেন হয়ে উঠছে জনপ্রিয়। অথচ ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, সত্যের পক্ষে দাঁড়াও এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যদিও তা তোমার নিজের স্বজনের বিরুদ্ধেই হোক।

অপবাদ দেওয়া মানে কাউকে এমন অপরাধে অভিযুক্ত করা, যা সে করে না। ইসলামে এটিকে ‘বুহতান’ বলে। এটি কবিরা, যা বড় পাপের অন্তর্ভুক্ত। কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা সচ্চরিত্র, নিরীহ, ইমানদার নারীদের অপবাদ দেয়, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সুরা নুর ২৩)

এই আয়াতে শুধু নারীদের উদাহরণ আনা হয়েছে, কারণ সে যুগে নারী সমাজ ছিল বেশি আক্রান্ত। কিন্তু এর বিধান সর্বজনীন। হোক সে নারী বা পুরুষ, অন্যায় অপবাদ দেওয়ার পরিণাম ভয়াবহ। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে মিথ্যা অপবাদ দেয়, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাকে আগুনের ঢিবির ওপর দাঁড় করাবেন, যতক্ষণ না সে তার অপরাধের শাস্তি ভোগ করে।’ (মুসনাদে আহমদ)

নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিন সম্পর্কে এমন কিছু বলে, যা তার মধ্যে নেই, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের মধ্যে এমন স্থানে রাখবেন, যেখান থেকে পুঁজ ও নাপাক তরল বের হয়।’ (আবু দাউদ) এমনকি অপবাদ ও চরিত্র হননের অপরাধকে রাসুল (সা.) সর্বাপেক্ষা জঘন্য সুদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ‘সুদের চেয়ে ভয়াবহ গুনাহ হলো, অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানের সম্মানহানি করা।’ (আবু দাউদ)

মেরাজের রাতে নবী করিম (সা.) দেখেন, একদল লোক তামার তৈরি নখ দিয়ে নিজেদের মুখ ও বুক আঁচড়াচ্ছে। তিনি জিবরাইল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? উত্তরে জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা ওই সব লোক, যারা মানুষের গোশত খায় (গিবত করে) এবং সম্মানহানি করে।

বিদায় হজের ভাষণে নবী করিম (সা.) স্পষ্ট ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান একে অপরের জন্য হারাম, যেমন এই দিন, এই শহর ও এই মাস সম্মানিত।’ (সহিহ মুসলিম)

ভাবা যায়, একটা মিথ্যা কথা, একটা ছড়িয়ে দেওয়া অপবাদ কারও ইজ্জত কেড়ে নিতে পারে, তাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। আর সেই কুখ্যাত অপবাদদাতা হেসে বেড়ায় সমাজে, গর্ব করে বলে, ‘আমি কাউকে ছাড়ি না।’ হায় আফসোস, কী ভয়ংকর কথা! কী ভয়াবহ পরিণতি তার জন্য অপেক্ষা করছে!

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে গুজব ছড়ানো, অপবাদ দেওয়া, মিথ্যা প্রসার করা যেন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো যাচাই-বাছাই নেই, কোনো দ্বিধা নেই। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘মানুষের কাছে সঠিক ও ভুল উভয় ধরনের কথাই পৌঁছায়। কিন্তু সে যদি যাচাই ছাড়া ভুল তথ্য ছড়ায়, তবে সে মিথ্যাবাদী হিসেবে বিবেচিত হবে।’ রাসুল (সা.) এটিকে কবিরা গুনাহ হিসেবে গণ্য করে বলেছেন, ‘এক মুসলিম আরেক মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করবে না, তাকে অপমান করবে না।’ (সহিহ মুসলিম)

আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও ছবি, কোনো ক্লিপ বা একতরফা তথ্য দেখে অনেকেই মন্তব্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রমাণ ছাড়াই মন্তব্য করেন। কেউ বলেই ফেলেন, ‘সে তো নিশ্চয় এমনই।’ আর কেউ বলেন, ‘আমি জানি সে ঠিক কী ধরনের মানুষ।’ এসব কথায় একজন মানুষ, একটা পরিবার, একটা জীবন সব শেষ হয়ে যেতে পারে। আর তথ্য যাচাই না করে এমন মন্তব্যকারীদের আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে গুনাহের পাহাড়।

ইসলাম বলে, কারও বিরুদ্ধে কথা বলার আগে তা সত্য কি না এই সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হতে হবে। যদি প্রমাণ না থাকে, তাহলে নীরবতা অবলম্বন করতে হবে। কেউ অপবাদ দিলে তার কথা না ছড়িয়ে বলতে হবে, এটা গুনাহের কাজ।

অপবাদ দেওয়া, গুজব ছড়ানো, মিথ্যা অভিযোগ, এসব কোনো হালকা বা তুচ্ছ গুনাহ নয়। বরং এগুলো সেই ভয়ংকর অপরাধ, যা মুনাফিকদের চরিত্রের পরিচয় বহন করে, ফাসিকদের স্বভাব প্রকাশ করে এবং আখেরাতে চরম ধ্বংস ও লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো মানুষকে ধ্বংস করে দেয় নিঃশব্দে ও চুপিসারে।

এখন সময় এসেছে আমাদের আত্মসমালোচনার। আমরা কি সত্যিই অপবাদ দেওয়া থেকে মুক্ত? আমরা কি যাচাই ছাড়া কথা বলি না? আমরা কি অন্যের সম্মান নষ্ট করে নিজের ইমানকে ধ্বংস করছি না? তাই আসুন, এই ভয়াবহ ব্যাধির বিরুদ্ধে নিজেকে ঢাল বানাই। পরিবারকে সতর্ক করি। সমাজকে জাগিয়ে তুলি। আল্লাহ যেন আমাদের জিহ্বাকে অপবাদ ও মিথ্যার পাপ থেকে হেফাজত করেন এবং সত্য ও ইনসাফের পথে দৃঢ় রাখেন। আমিন।

No comments

Powered by Blogger.