জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে অ্যালার্জি সমস্যাকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে
ঋতুভিত্তিক অ্যালার্জিতে ভুগছেন এমন লোকদের এখন আগের চেয়ে আরও দীর্ঘ সময় ধরে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এই অ্যালার্জি মূলত পরাগজনিত অ্যালার্জি হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পরাগজনিত অ্যালার্জিতে দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে হচ্ছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে পৃথিবীর ক্রমাগত বাড়তে থাকা তাপমাত্রা। তাই জলবায়ু পরিবর্তন অ্যালার্জি সমস্যাকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে বলেও সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে এই পরাগজনিত অ্যালার্জির কারণে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সেদিন বাতাস আচমকাই প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে, শুরু হয় বজ্রঝড়। এসময় বৃষ্টির ফোঁটা, বজ্রপাত ও আর্দ্রতা বাতাসে থাকা কোটি কোটি পরাগ কণাকে ভেঙে ছোট ছোট কণায় রূপান্তর করে এবং তা মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে, যা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে।
হঠাৎ হাসপাতালে শ্বাসকষ্ট নিয়ে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় আট গুণ এবং হাঁপানির রোগীর সংখ্যা দশ গুণ। রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে চরম সংকট দেখা দেয়। ২০ বছর বয়সি একজন আইনের ছাত্রী নিজ বাড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মারা যান।
এই ঘটনাকে পরে ‘থান্ডারস্টর্ম অ্যাজমা’ বা বজ্রঝড়জনিত হাঁপানির ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়; যেখানে ঝড় চলাকালে বাতাসে থাকা পরাগকণাগুলো ভেঙে অতি ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয় এবং তা সহজেই মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করে তীব্র অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
পরিবেশ স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী এবং অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককোয়ারি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পল বেগস বলেন, ‘এটি ছিল এক ভয়াবহ ঘটনা– নজিরবিহীন এবং ধ্বংসাত্মক।’
বজ্রঝড়জনিত হাঁপানি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি চরম উদাহরণ হলেও এর বাইরেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক অঞ্চলে সাধারণ ঋতুভিত্তিক অ্যালার্জির মৌসুমও দীর্ঘতর হচ্ছে, পরাগের মাত্রা বাড়ছে এবং উপসর্গগুলো আরও খারাপ হচ্ছে।
পরাগ হলো উদ্ভিদের প্রজননের জন্য অপরিহার্য ক্ষুদ্র কণা। অনেক উদ্ভিদ পোকামাকড়ের মাধ্যমে পরাগ ছড়ালেও গাছ, ঘাস এবং আগাছা প্রজাতির অনেক উদ্ভিদ বাতাসের মাধ্যমে পরাগ ছড়ায়। আর এগুলোই মূলত ঋতুভিত্তিক অ্যালার্জির জন্য দায়ী।
আমাদের শরীর ভুলবশত এই পরাগকে ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে শনাক্ত করে এবং সাধারণত ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের জন্য সংরক্ষিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই পরাগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এর ফলে সর্দি, চোখ চুলকানো, হাঁচি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। কারো কারো ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টও হয়।
বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড বাড়লে উদ্ভিদ বেশি পরিমাণে পরাগ তৈরি করে এবং এর অ্যালার্জি সৃষ্টির ক্ষমতা বাড়ে।
চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯টি অঙ্গরাজ্যে আগের যেকোনো বছরের তুলনায় বেশি পরাগের উপস্থিতির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
পল বেগসের গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন পরাগের মৌসুমকে দীর্ঘায়িত করছে এবং বিভিন্ন ধরণের পরাগ মানুষের সামনে আসছে। ২০২৪ সালে তার প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বজ্রঝড়জনিত হাঁপানি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়।
ঝড় কীভাবে পরাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ?
বজ্রঝড় চলাকালে ঠান্ডা বাতাস নিচের স্তরে ধাক্কা দিয়ে গাছ-ঘাস থেকে পরাগ কণাকে উপরের দিকে তোলে। মেঘের আর্দ্রতায় সেগুলো ফুলে উঠে এবং ভেঙে আরও ছোট টুকরোতে পরিণত হয়, যার ফলে বাতাসে অ্যালার্জেন কণার সংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে যায়। এই ছোট কণাগুলো ঠান্ডা বাতাসের সাথে আবার নিচে নেমে আসে এবং সহজেই মানুষের শ্বাসনালীতে ঢুকে পড়ে। ঝড়ের শুরু থেকে প্রথম ২০–৩০ মিনিটে পরাগের মাত্রা সবচেয়ে বেশি হয়।
এ ধরনের ঘটনা এখনো বিরল হলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যেমন পরাগ মৌসুম দীর্ঘ করছে, তেমনি বাড়াচ্ছে চরম আবহাওয়ার ঘটনাও– যা এই ঝুঁকিকে আরও বাড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক দেশে পরাগ মৌসুম এখন আগেভাগেই শুরু হচ্ছে এবং বেশি সময় ধরে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের র্যাগউইড নামক আগাছা জাতীয় উদ্ভিদ এক বিলিয়নের বেশি পরাগ কণা ছড়াতে পারে– যা ইতোমধ্যে ৫ কোটির বেশি মার্কিন নাগরিকের অ্যালার্জির কারণ।
১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকার ১১টি জায়গার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১০টি স্থানে র্যাগউইড উদ্ভিদের পরাগ মৌসুম দীর্ঘ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ লুইস জিস্কা বলেন, ‘যতবার আমরা কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়েছি, র্যাগউইড গাছগুলো আরও বেশি পরাগ তৈরি করেছে।’ এমনকি তারা আরও শক্তিশালী অ্যালার্জেনও (অ্যালার্জি সৃষ্টির ক্ষমতা) তৈরি করছে।
একই প্রবণতা দেখা গেছে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়াতেও। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে র্যাগউইড উদ্ভিদের পরাগের মাত্রা বর্তমানের তুলনায় চারগুণ বেশি হতে পারে।
সমাধান কী হতে পারে ?
এই অ্যালার্জিকে মোকাবেলা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে– গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো। অতীতে যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় সরকারগুলো র্যাগউইড গাছ নির্মূলের জন্য কর্মসূচি চালিয়েছে। যেমন, ১৯৩২ সালে শিকাগো শহরে ১,৩৫০ জন শ্রমিক নিয়োগ করা হয় শুধুমাত্র এই গাছ কাটার জন্য।
আজকের দিনে ইউরোপে বেশ কিছু দেশ এই উদ্যোগ নিচ্ছে। জার্মানির বার্লিনে কর্মীরা র্যাগউইড খুঁজে তা তুলে ফেলে। সুইজারল্যান্ড ২০২৪ সালে গাছটি আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে
এছাড়া শহরের পরিকল্পনায় পরিবেশবান্ধব গাছপালা রোপণের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন অ্যালার্জিজনিত উদ্ভিদ না লাগানো হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো– পরাগমাত্রা পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাসের উন্নতি করতে হবে। আমরা দৈনিক তাপমাত্রা বা বৃষ্টির পূর্বাভাস সহজেই পেয়ে যাই, কিন্তু পরাগ বা অ্যালার্জেনের মাত্রা নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পরাগ নয়, প্রতিটি পরাগ কণার অ্যালার্জেনিকতা আলাদা– তাই ভবিষ্যতে অ্যালার্জেন মাত্রা নিয়মিত পরিমাপ করা জরুরি।
এভাবে অ্যালার্জেনের মাত্রা জেনে নিজেদেরকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন– এটি মোকাবেলার সময় এখনো আছে। যদি বিশ্ব এখনই পদক্ষেপ নেয়, তাহলে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। কিন্তু যদি কিছুই না করা হয়, তাহলে ঋতুভিত্তিক অ্যালার্জি আরও দীর্ঘ, তীব্র ও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
পল বেগস বলেন, ‘আমরা এখন যথেষ্ট গবেষণা তথ্য পেয়েছি। এগুলোতে উঠে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব মানবস্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে এবং সামনে আরও খারাপ সময় আসছে।’
No comments