এই মুহূর্তটির জন্য ৩০ বছর অপেক্ষায় ছিলেন নেতানিয়াহু, সফল হবেন কি
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তিন দশক ধরে বলে আসছেন, ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। এই সময়ের মধ্যে অন্তত দুবার তিনি ইরানে হামলা চালানোর প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হামলা চালাতে পারেননি। তবে এবারে ৭৫ বছর বয়সী ইসরায়েলি এই প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেশের ইতিহাসে ইরানের ওপর সবচেয়ে বড় হামলা শুরু করেছেন।
এটি বিরাট ঝুঁকি এবং বিশাল প্রতিশ্রুতির অভিযান। এই অভিযান ইসরায়েলের দীর্ঘতম শাসক নেতানিয়াহুর উত্তরাধিকারকে সংজ্ঞায়িত করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে উল্টে দেবে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু বলেন, তিনি গত নভেম্বরেই এই হামলার প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে, এই দুঃসাহসিক আক্রমণ বহু বছর ধরে চলে আসা বিভিন্ন ঘটনার সংমিশ্রণের ফল।
হামাসের ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলা ইসরায়েলকে প্রতিরক্ষা কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে এবং সামরিক বাহিনীকে হিজবুল্লাহর মতো ইরানি প্রক্সি হুমকি দমন করার সুযোগ দিয়েছে। বছরের পর বছর প্রচেষ্টার পর, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের এত গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে যে, তারা দেশের ভেতর থেকেই তাদের সুরক্ষিত পারমাণবিক কর্মসূচিতে আঘাত হানতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহায়ক ভূমিকা এবং ইসরায়েলি নেতৃত্বের কট্টরপন্থী অংশ নেতানিয়াহুকে এই পদক্ষেপ নিতে সক্ষম করেছে। অথচ, তিনি দীর্ঘ তিন দশক ধরে এটি এড়িয়ে যাচ্ছিলেন।
প্রথম দফা হামলার এক দিন পর এই নতুন যুদ্ধ কীভাবে এগিয়ে যাবে এবং ইরান-ইসরায়েলের বাইরেও এটি ছড়িয়ে পড়বে কি না, তা মূল্যায়ন করা এখনো অনেক চটজলদি হয়ে যাবে। তবে প্রাথমিক প্রতিবেদনগুলোর বরাতে ইসরায়েলি ভাষ্যকাররা বলছেন, হামলা এখন পর্যন্ত সফল। কারণ, এতে ডজনখানেক শীর্ষ ইরানি সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন, একটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ইরানের প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা সীমিত হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা ইস্পাহানের আরেকটি পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে।
এর পরপরই ইরান ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশের মধ্যাঞ্চলে ইরানি হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ‘শক্তি প্রয়োগ করার’ এবং ইসরায়েলি হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এই প্রতিশোধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয়ভাবেই হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে এবং ইসরায়েলের এই হামলা কয়েক দিন বা সপ্তাহ ধরে চলতে পারে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইরান-সমর্থিত হামাসের সদস্যরা ইসরায়েলে প্রবেশ করে হামলা চালায়। এরপর থেকেই ইসরায়েল সীমান্ত সুরক্ষায় অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। দেশটি গাজা, লেবানন ও সিরিয়ার ভেতরে সৈন্য মোতায়েন করেছে এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যর ওপর কম নির্ভর করে তাদের সক্ষমতার ওপর বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
এরপর থেকে ইসরায়েল গাজায় একটি নৃশংস যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। গাজার বিশাল এলাকা ধ্বংস করেছে এবং প্রায় ৫৫ হাজার জনকে হত্যা করেছে। তবে ইসরায়েলি বর্বরতা হামাস ও হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার ধ্বংস করেছে এবং সিরিয়ায় সরকারের পতনে সহায়তা করেছে।*-ইসরায়েলি এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা এবং সাবেক এক মোসাদ কর্মকর্তা ইসরায়েলের হামলাকে ইরানের ভেতরে চৌকস গোয়েন্দা অভিযান হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এই অভিযানে প্রচুর পরিমাণে বিশেষ অস্ত্রশস্ত্র পাচার করে ইরানের ভেতরে মোতায়েন করা হয়েছিল এবং যুদ্ধবিমানগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সময় একই সঙ্গে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকারী এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
অপারেশনের বিষয়ে ব্রিফ করা সাবেক শীর্ষ মোসাদ কর্মকর্তা সিমা শাইন বলেন, ‘ইরানে বিস্ফোরক ড্রোনের একটি ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছিল। হামলার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে (এই বিস্ফোরক) ইরানে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছিল।’
বর্তমান অভিযানের চালিকাশক্তি নেতানিয়াহু, যার জনপ্রিয়তা ঘুষ ও জালিয়াতির অভিযোগের কারণে এবং হামাসের হামলার কারণে ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। এমনকি সর্বশেষ হামলার আগের দিন, বৃহস্পতিবার পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার চেষ্টার মাধ্যমে তাঁকে প্রায় ক্ষমতাচ্যুতই করা হয়েছিল। তবে আংশিকভাবে ‘ইরান অভিযানে’র দোহাই দিয়ে তিনি রক্ষা পেয়েছেন। এখন ইসরায়েলিরা নেতানিয়াহুর পাশে একত্রিত হচ্ছে। এমনকি বিরোধী নেতা বেনি গান্তজও শুক্রবারের হামলার সিদ্ধান্তকে প্রশংসা করেছেন।
নেতানিয়াহু ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকেই যুক্তি দিয়ে আসছেন যে, ইসরায়েলের জন্য ইরানের চেয়ে বড় কোনো হুমকি নেই। ইরান ইহুদি রাষ্ট্রকে অবৈধ বলে প্রত্যাখ্যান করে আসছে এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইসরায়েল-বিরোধী প্রতিনিধিদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে।
২০১০ সালে এবং আবার ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে হামলা চালানোর প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর নিরাপত্তা প্রধান ও শীর্ষ মন্ত্রীরা—এবং তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা—আপত্তি করায় তিনি পিছিয়ে আসেন। আজ, তাঁর সহযোগী ও শীর্ষ মন্ত্রীরা সবাই সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করছেন।
তাঁর পূর্বসূরি, এহুদ ওলমার্ট—যিনি রাজনৈতিকভাবে ডানপন্থী হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও এখন স্পষ্টভাবে বামপন্থী—বলেছেন, তিনিও ইরান আক্রমণ করার কথা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছিলেন কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন এবং তাঁর নিজেরও সন্দেহ ছিল।
ওলমার্ট গত সপ্তাহে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সর্বজনীন ধারণা ছিল, আমরা ইরানকে দেড় বছরের জন্য পিছিয়ে দিতে পারব। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যে, দেড় বছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের সবকিছু উলটপালট করে দেব কি না। এটা অযৌক্তিক ছিল।’
বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আলোচনার পক্ষে জনমুখী অবস্থান নিলেও ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের প্রতি আরও বেশি সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি শুক্রবারের ইরানে ইসরায়েলি হামলার প্রশংসা করে বলেছেন, তিনি ইরানিদের সতর্ক করেছিলেন যে—তারা যদি সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে সম্মত না হয়, তবে তারা সামরিক হামলার শিকার হবে। তিনি বলেন, হামলাগুলো ইরানকে আপস করতে উৎসাহিত করতে পারে যদিও তেহরানের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বেশ শক্তই বলে মনে হচ্ছে।
ইসরায়েলের পক্ষ এখন দুটি অপশন খোলা আছে। প্রথমত তারা একাই ইরানে হামলা চালাবে। কিন্তু তাতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সামান্য বিলম্বিত হলেও ধ্বংস হবে না। একই পরিস্থিতি ছিল এহুদ ওলমার্টের আমলেও। পরের বিকল্প হলো—মার্কিন নেতৃত্বে হামলা। যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমান দিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বাংকার ব্লাস্টার বোমা দিয়ে হামলা চালানো। কিন্তু ট্রাম্প এখনো এতে রাজি নন।
নেতানিয়াহুর সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইয়াকভ আমিদরর বলেন, যখন ইরান ১৯৯০-এর দশকে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে, তখন বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, বোমা তৈরি করতে ১০ থেকে ১৫ বছর লাগবে। তিনি বলেন, ‘১৫ বছর পেরিয়ে গেছে এবং তাদের এখনো বোমা নেই। আমরা জানি, আমরা সময় নিয়ে খেলছি। যদি আমরা এটিকে আরও দুই থেকে তিন বছর বিলম্বিত করতে সফল হই, তবে এটি যথেষ্ট ভালো। শেষ পর্যন্ত, একটি চুক্তি বা শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।’
No comments